আসুন, ভারতকে এই একটা ক্ষেত্রে অনুসরণ করি

আনিসুল হকঃ অতিরিক্ত খাওয়ার ফলে পেটটা যখন আইঢাই করছে, তখন বললাম, ইনো আছে নাকি? ইনো খেলে নাকি সব হজম হয়ে যায়। আমাদের পরিবারে ভারতীয় পন্য সামগ্রীডাক্তারের সংখ্যা বেশি। তাঁদেরই একজন বললেন, তুমি যে ইনো খুঁজছ, এর কারণ হলো ভারতীয় টেলিভিশন। বাংলাদেশের ওষুধনীতি অনুযায়ী এ ধরনের ওষুধ তৈরি নিষেধ, আর সব ধরনের ওষুধের বিজ্ঞাপন প্রচারও নিষেধ। কিন্তু ভারতে তা নয়। ফলে ভারতের ব্যথাবেদনার মলম, দাঁতের ব্যথার মলম, হজম হওয়ার টোটকা—এসব দিয়ে আমাদের বাজার ভর্তি।

এর সঙ্গে মেলাতে পারেন অর্থনীতিবিদ বিনায়ক সেনের পর্যবেক্ষণ। প্রথম আলোয় ৭ সেপ্টেম্বর ২০১১ প্রকাশিত ‘কাঁটাতারের বেড়া’ শীর্ষক নিবন্ধে তিনি বলেছেন, ‘কাঁটাতারের বেড়া যে আছে, তার প্রমাণ বাংলাদেশি চ্যানেলের অনুষ্ঠান ভারতবর্ষে প্রচারিত হতে না দেওয়া। এটা দেওয়া হয় না ওপরের নির্দেশেই।’

ভারত যে বাংলাদেশের চ্যানেল দেখায় না, তার কারণ, তাদের দেশপ্রেম আছে। তারা তাদের দেশকে ভালোবেসে শুধু চোখের পানি ফেলে না, তারা সেটা কাজেও পরিণত করে দেখায়। পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশের টেলিভিশন একসময় খুবই জনপ্রিয় ছিল। তখনো স্যাটেলাইট চ্যানেল আসেনি। ওই সময় বাংলাদেশি কোম্পানিগুলোর সাবান কলকাতার বাজারে খুবই বিক্রি হতো। এখন ভারতীয়রা বাংলাদেশের চ্যানেল দেখে না। আমরা ভারতীয় চ্যানেল দেখি। ভারতীয় ছবি দেখি। তার ফলাফল কী হচ্ছে?

চমৎকার একটা প্রতিবেদন বেরিয়েছে ডেইলি স্টার-এর ম্যাগাজিনে, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১১। লিখেছেন তামান্না খান। ‘হয়ার দি স্কাই ইজ লিমিটেড’ নামের এই প্রতিবেদনটি তামান্না খান শুরু করেছেন একটা উদাহরণ দিয়ে। তিনি লিখেছেন, ‘মুনিরা খান সান্ধি সুধা খুঁজছেন। ব্যথার মলম। ভারতীয় স্যাটেলাইট চ্যানেল জিটিভিতে বিজ্ঞাপিত। যে চ্যানেল দেখার জন্য তিনি তাঁর কেব্ল অপারেটরকে মাসিক গ্রাহক মূল্য (সাবস্ক্রিপশন ফি) পরিশোধ করেন। সান্ধি সুধা একটা ভারতীয় পণ্য। মুনিরা খান সেটা আনার জন্য ডলার দিয়ে একজনকে ভারতে পাঠালেন। ফলটা দাঁড়াল, ভারত রেভিনিউ আয় করল জিটিভির গ্রাহক চাঁদা থেকে, সান্ধি সুধা বিক্রি থেকে এবং ক্রেতার ভ্রমণ খরচ থেকে।

‘শুধু হারবাল ওষুধ থেকে নয়, ভারতীয় স্যাটেলাইট চ্যানেল, ফ্যাশন, সংগীত, চলচ্চিত্রের কারণে বাংলাদেশি দর্শকদের ঘরে ঘরে এখন সব ধরনের ভারতীয় ভোগ্যপণ্যের সমাহার।’

তামান্না খানের ওই প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, প্রতিবছর দুই হাজার কোটি টাকা আমরা ভারতকে দিয়ে থাকি শুধু জি, সনি, স্টারের মতো পে-চ্যানেল দেখার জন্য। আর ভারতীয় ‘মাসাক কালি’জাতীয় শাড়ি থেকে শুরু করে হিরো বাইক বা টাটা-মারুতির মাধ্যমে কত হাজার কোটি টাকা ভারতকে দিয়ে থাকি, তার হিসাব নিয়েই তো বসেছিলেন দুই দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা। বাণিজ্য ঘাটতি এত বিশাল যে, মনমোহন সিংয়ের সফরের সময় বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের ৪৬টা আইটেম বিনা শুল্কে ভারতে প্রবেশ করতে দেওয়ার চুক্তি করতে হয়েছে। ভারত যদি এর বাইরেও অন্যান্য পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দেয়, আপনি নিশ্চিত থাকুন, ওই সব পণ্য ভারতে বাজার পাবে না। নন-ট্যারিফ বাধা তো থাকবেই, আসলে থাকবে বাংলাদেশি পণ্য ক্রয়ে ও ব্যবহারে ভারতীয় নাগরিক ও ব্যবসায়ীদের অনীহা। এর একটা কারণ, ওরা এই সব পণ্য সম্পর্কে জানে না। জানে না, কারণ জানানোর কোনো উপায় নেই। বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেল ভারতে প্রচারিত হয় না। বাংলাদেশের পত্রিকা ভারতে বিক্রি হয় না। অভিন্ন ভাষা হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের বই কলকাতাওয়ালারা কেনে না এবং পড়ে না। মাত্র সেদিন অন্যদিন-এর সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম আমাকে বললেন, হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস নেওয়ার জন্য কলকাতার শীর্ষস্থানীয় পত্রিকাটি আগে হন্যে হয়ে পড়ে থাকত। এর কারণ ছিল, বাংলাদেশে ওই পত্রিকার পূজাসংখ্যার বিক্রি বাড়ানো। কিন্তু যখন দেখা গেল, পশ্চিম বাংলার বাজারে হুমায়ূন আহমেদের বইয়ের চাহিদা বেড়ে যাচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে তারা হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস ছাপানো বন্ধ করে দিল।

গত ১৭ সেপ্টেম্বর বিবিসি বাংলায় কলকাতা থেকে অমিতাভ ভট্টশালীর পাঠানো একটা প্রতিবেদন প্রচারিত হয়েছে। শিরোনাম ‘বাংলাদেশি চ্যানেলে আপত্তি নেই ভারতের’। তাতে ভারতের তথ্য-সম্প্রচার দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী চৌধুরী মোহন জাটুয়া বলেছেন, ‘আইন অনুযায়ী যেকোনো বিদেশি চ্যানেল ভারতে সরাসরি সম্প্রচার করা যায় না। তার জন্য ভারতে নিবন্ধীকৃত কোনো শাখা তৈরি করতে হয়। কোনো মাল্টি সার্ভিস অপারেটর বা এমএসওর মাধ্যমে যদি কোনো বিদেশি চ্যানেল ভারতে সম্প্রচার করতে চায়, তাহলেও সেই এমএসও আইন অনুযায়ী নিবন্ধীকৃত কি না, তা খতিয়ে দেখতে হয়। আবেদন পেলে আমরা কিছু খোঁজখবর নিই, তারপর অনুমোদন দিই। বাংলাদেশি চ্যানেলগুলো সেইভাবে আবেদন করলে ভারতে সম্প্রচার করতে পারবে—এতে তো কোনো বাধা নেই।’

কিন্তু বিবিসির ওই প্রতিবেদনেই বলা হয়েছে, এমএসও-রা বলছে, বাংলাদেশি চ্যানেলগুলো ভারতের তথ্য-সম্প্রচার মন্ত্রকের অনুমোদনপ্রাপ্ত বিদেশি চ্যানেলের তালিকায় নেই। সে জন্যই বাংলাদেশের কোনো চ্যানেল তারা প্রচার করে না।

শুধু যে ভারতীয় তথ্য মন্ত্রণালয় অনুমোদন দেয়নি, সমস্যা এখানে নয়। সমস্যা হলো, এমএসওগুলো বাংলাদেশের টিভি চ্যানেল প্রচারের জন্য ক্যারেজ ফি-র নামে বিপুল অঙ্কের টাকা দাবি করে থাকে। ডেইলি স্টার-এর ওই প্রতিবেদনে এটিএন বাংলার চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমানকে উদ্ধৃত করা হয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘যখন আমাদের প্রতিনিধিরা কলকাতার কেব্ল অপারেটরদের সঙ্গে কথা বলেন, তখন তাঁরা আমাদের কাছে বিশাল অঙ্কের টাকা দাবি করেন। প্রতিবছর তাঁরা দুই-তিন কোটি টাকা দাবি করেন। এত টাকা দিয়ে ওই দেশে চ্যানেল চালানো সম্ভব না।’

অন্যদিকে আমার সঙ্গে কথা হয়েছে চ্যানেল আইয়ের ফরিদুর রেজা সাগরের। তিনি বলেন, ‘সরকার যদি আমাকে বৈধভাবে ভারতে টাকা পাঠানোর অনুমতি দেয়, আমি তার চেয়ে বেশি টাকা ভারতীয় বিজ্ঞাপন থেকে আয় করে নিয়ে আসতে পারব বলে বিশ্বাস রাখি। কিন্তু সরকার অনুমতি দেয় না। আমরা তো দুবাইয়ে অনুষ্ঠান করার জন্য যে পরিমাণ টাকা নিয়ে গিয়েছিলাম, বিজ্ঞাপন থেকে আয় করে তার চেয়ে বেশি টাকা নিয়ে এসেছি।’
যা-ই হোক, এখন ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে, সনি-জি-স্টার টিভি দেখার জন্য প্রতিবছর আমরা দুই হাজার কোটি টাকা ভারতকে দিচ্ছি। তাদের পণ্য ব্যবহার করে কোটি কোটি টাকা তাদের ঘরে তুলে দিচ্ছি। কিন্তু আমাদের স্যাটেলাইট চ্যানেল দেখানোর জন্য আবার বছরে দুই-তিন কোটি টাকা চ্যানেলপ্রতি আমাদের দিতে হবে।

সংস্কৃতি মানে কিন্তু কেবল গান-বাজনা নয়, সংস্কৃতি হলো একটা জনগোষ্ঠীর পরিচয়, সে কী খায়, কী পরে, কী বলে, কীভাবে ঘুমায়। পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির অবস্থা খুবই শোচনীয়। পশ্চিমবঙ্গের লেখকেরা অনেকবার সাক্ষাৎকার দিয়ে বলেছেন, বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ নিহিত আছে বাংলাদেশে। তাঁরা মোটামুটি হিন্দি সংস্কৃতির কাছে পরাজয় মেনে নিয়েছেন। এবং তাঁরা পরম আগ্রহভরে তাকিয়ে আছেন বাংলাদেশের দিকে।

কিন্তু বাংলাদেশে আমরা হিন্দি চ্যানেলগুলোকে ঘরে ঘরে জায়গা করে দিয়ে বাঙালি সংস্কৃতিকে দূরে ঠেলে দিচ্ছি। সবচেয়ে ভয়াবহ খবর হলো, নিক ও ডিজনি চ্যানেলে শিশুদের অ্যানিমেশন বা কার্টুন ছবিগুলো হিন্দিতে প্রচারিত হচ্ছে। বাংলাদেশের ঘরে ঘরে বাচ্চারা সারা দিন ওই টিভি দেখছে। তারা আর বাংলায় ঠিকমতো নিজেকে প্রকাশ করতে পারে না। আমার এক ভাগনি বলেছিল, ‘তুমি যা, সেটাকে বাংলায় কী বলে? আমি হিন্দিটা জানি। মশহুর।’ আমার গর্বিত হওয়া উচিত। আমি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম। সে গাড়িতে যানজটে বসে থেকে বলে উঠেছিল, ‘ম্যায় তো তাং আ চুকি হুঁ।’

হিন্দি চ্যানেলগুলো বাংলাদেশের চার কোটি মানুষের কাছে পৌঁছেছে। ওই সব ঘরে বাচ্চারা হিন্দি শিখে বড় হচ্ছে। এখনো ১২ কোটি মানুষের কাছে হিন্দি পৌঁছায় না। কিন্তু বড় পর্দায় হিন্দি ছবি দেখানোর উদ্যোগ সফল হলে সেই কাজটাও সম্পন্ন হবে। জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক বলেছিলেন, ‘বাংলা ভাষাটাকে বাঁচায়া রাখছে কৃষক শ্রমিক সাধারণ মানুষ। তারা বাংলায় কথা কয় বইলাই কবি কবিতা লিখতে পারে। ল্যাটিন বা সংস্কৃতে কেউ কথা কয় না, তাই ওই ভাষাতে সাহিত্য রচিত হয় না।’ দেখেশুনে মনে হচ্ছে, আমাদের ভাবটা এমন যে আমরা কৃষক-শ্রমিকের ঘরে হিন্দি তুলে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছি। হিন্দি ছবি দেখা ও হিন্দিতে বিনোদিত হওয়া বাংলাদেশিদের মৌলিক অধিকার। ওই অধিকার প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম চলবে।

ছবি মানে যে শুধু ছবি নয়, তা আমরা স্বীকার করব না। তাতে যে পণ্যের বিজ্ঞাপন হয়, আদর্শের বিজ্ঞাপন হয়, জীবনবোধের বিজ্ঞাপন হয়, সে বিষয়টা আমরা জেনেও না জানার ভান করব। ওদের আইডল বা প্রতিমাকে নিজের প্রতিমা ভেবে পূজা করব।

তবু আমি দরোজা-জানালা বন্ধ করার পক্ষে নই। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা, চৌরাশিয়ার বাঁশি, জাকির খানের তবলা, ঋতুপর্ণ ঘোষের ছবি আমরা নিশ্চয়ই উপভোগ করব। কিন্তু হিন্দি চ্যানেল ও ছবিকে আমরা কতটা উৎসাহিত করব, সে বিষয়ে আমাদের অবশ্যই ভাবতে হবে। এবং এই ভাবনাটা আসতে হবে আমাদের পক্ষ থেকে, আমরা যারা ভোক্তা। সরকার এ বিষয়ে খবরদারি করতে গেলে সেটা আবার না গণতান্ত্রিক অধিকারের ওপর খবরদারিতে পর্যবসিত হয়, সেই শঙ্কা আমাদের সব সময়ই থাকে। তামান্না খানের প্রতিবেদনের শেষ দুটো বাক্য উদ্ধৃত না করে পারছি না, ‘সুতরাং এরপর যখন আমরা প্রিয়া আর রামকাপুরের (হিন্দি সিরিয়ালের দুটো চরিত্র) বিয়ের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হব, কিংবা বাজারে গিয়ে আকসারার শাড়ি (আরেকটা হিন্দি সিরিয়ালের চরিত্র) খুঁজব, সম্ভবত আমাদের মনে রাখতে হবে ২০০০ কোটি টাকার কথা।’ যে টাকাটা আমরা প্রতিবছর ভারতীয়দের হাতে দিই এই পে-চ্যানেলগুলো দেখার জন্য।

আসলেই আমাদের শেখার অনেক কিছু আছে ভারতের কাছ থেকে। একটা শিক্ষা কি আমরা ভারতের কাছ থেকে গ্রহণ করব? তা হলো, ওরা ওদের দেশে বাংলাদেশি চ্যানেল দেখানোর জন্য যা যা নিয়মকানুন মেনে চলছে, ভারতীয় চ্যানেলগুলোর জন্য আমরা হুবহু সেই সব নিয়মনীতি মেনে চলব। আমাদের কেব্ল অপারেটররা টাকা না পেলে ভারতীয় ফ্রি টু এয়ার চ্যানেল দেখাবে না। আর আমরা পে-চ্যানেলগুলো দেখব না। যদি পে-চ্যানেল দেখাতেই হয়, তাহলে কি বাংলাদেশ সরকার প্রতিটা পে-চ্যানেলের জন্য সমপরিমাণ ট্যাক্স আরোপ করতে পারে না? মানে, যে দুই হাজার কোটি টাকা আমরা ভারতে পাঠাচ্ছি, সমপরিমাণ টাকা বাংলাদেশ সরকারের ঘরে জমা পড়বে। কেউ যদি একটা হিন্দি চ্যানেলের গ্রাহক হতে চায়, এ জন্য মাসে তাকে মাত্র ১০টা টাকা চ্যানেলপ্রতি ট্যাক্স দিতে হবে। যার বাড়িতে ১০টা পে-চ্যানেল আছে, সে ১০০ টাকা অতিরিক্ত বাংলাদেশ সরকারের হাতে তুলে দেবে।

অন্তত একটা কাজ বাংলাদেশ সরকারকে করতেই হবে, আমাদের কেব্ল অপারেটরদের করতেই হবে—আমাদের আকুল আবেদন, দয়া করুন, নিক ও ডিজনির হিন্দি চ্যানেল দুটো প্রচার বন্ধ করে দিন। আপনাদের দোহাই লাগে, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে এই ছোট্ট কাজটা অন্তত করুন।
 

আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

সূত্রঃ প্রথম আলো