গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষনাবেক্ষন কর্মসূচীতে ব্যাপক অনিয়ম

অবকাঠামো রক্ষনাবেক্ষন (টি.আর নগদ টাকা) কর্মসূচীর বিশেষ বরাদ্ধ প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রমান মিলেছে। অধিকাংশ প্রকল্প কাগজে থাকলেও বাস্তবে তার কোন অস্তিত্ব নেই। স্থানীয় কতিপয় আওয়ামীলীগ নেতারা ভূয়া প্রকল্প দেখিয়ে প্রকল্পের নামে বরাদ্ধকৃত টাকা আত্মসাত করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। কোন কোন প্রকল্পের টাকা নামেমাত্র প্রতিষ্ঠানে দিয়ে পুরো টাকাই ওইসব নেতারা হাতিয়ে নিয়েছেন। এছাড়াও উপজেলা হিসাব রক্ষন অফিসের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজসে অন্য প্রকল্পের টাকা ভূয়া সিপিসির মাধ্যমে উত্তোলন করতে গিয়ে রাসেল নামের এক যুবক গ্রেফতারও হয়েছে।

সরেজমিনে গিয়ে প্রতিষ্ঠান কর্মকর্তা, স্থানীয় লোকজন, আওয়ামীলীগ নেতা ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বরিশালের গৌরনদী উপজেলা ২০১০-২০১১ইং অর্থ বছরের গ্রামীন অবকাঠামো রক্ষনাবেক্ষন (টি.আর নগদ টাকা) বিশেষ বরাদ্ধ কর্মসূচী প্রকল্পে আওতায় গৌরনদী উপজেলার ৭টি ইউনিয়নে ও পৌরসভার ৯টি ওয়ার্ডে ১৩৬টি প্রকল্প গ্রহন করা হয়। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে বরাদ্ধ করা হয় ৮৭ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা।

গত ১৫ জুন এসব টাকা তুলে নেয়া হয়েছে। সরজেমিনে গিয়ে দেখা গেছে, গৌরনদী উপজেলার কতিপয় প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব পাওয়া গেলেও অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই কাগজে কলমে সীমাবদ্ধ। যা শুধুমাত্র কাগজে আছে বাস্তবে নেই। ত্রান ও পূর্নবাসন কার্যালয়ে দাখিলকৃত প্রকল্প বাস্থবায়ন কমিটিও ভূয়া এবং কমিটির সদস্যদের ভূয়া নাম ও ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। কমিটির  ছবি ও নামের লোকজনকে এলাকায় খুঁজে পাওয়া যায়নি। চাঁদশী ইউনিয়নের বকুলতলা জামে মসজিদের সংস্কারের জন্য ৩০ হাজার টাকা বরাদ্ধ করা হয় (প্রকল্প নং-৬১)। মসজিদ কমিটির সভাপতি ও সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ শওকত হোসেন অভিযোগ করেন, এ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ৩নং চাঁদশী ইউনিয়নের আওয়ামীলীগের সহসভাপতি মোঃ হিরন শরীফ জনৈক মোঃ কামরুল ইসলামকে প্রকল্প চেয়ারম্যান করে ৫সদস্য বিশিষ্ট একটি প্রকল্প কমিটি দাখিল করেন। সেখানে (কমিটিতে) যাদের নাম ও ছবি ব্যবহার করা হয়েছে তা ভূয়া। ওই নামে বা ওই ছবির কোন ব্যক্তি এই এলাকায় নেই। আওয়ামীলীগ নেতা হিরন প্রকল্পের টাকা তুলে আত্মসাত করেছে।

চাঁদশী ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডের দক্ষিণ নাঠৈ গ্রামের সিদ্দিক খলিফার বাড়ির মসজিদ উন্নয়নের জন্য ৩০ হাজার টাকা বরাদ্ধ করা হয় (প্রকল্প নং-৫৯)। মসজিদ কমিটির সভাপতি মাওলানা মোঃ ইসমাইল হোসেন ও সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন অভিযোগ করেন, ৩নং চাঁদশী ইউনিয়নের আওয়ামীলীগের সভাপতি মোঃ মাহাবুব চোকদার তাদেরকে ১৫ হাজার প্রদান করেছেন। এছাড়া পশ্চিম শাওড়া হিতৈষী ক্লাব উন্নয়নে ৩০ হাজার টাকা (প্রকল্প নং-৬০) বরাদ্ধ করা হয়। চাঁদশী ইউনিয়নরে মোঃ শামছুল হক, মোঃ শাহ আলম ওই ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মোঃ হিরন বেপারী জানান, ওই নামে কোন প্রতিষ্ঠান এলাকায় নেই।

ত্রান ও পূর্নবাসন অফিসে গিয়ে দেখা যায়, চাঁদশী ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি মোঃ মাহাবুব চোকদার প্রকল্প চেয়ারম্যান হিসেবে কমিটি দাখিল করে হিতৈষী ক্লাবের টাকা তুলে নিয়েছেন। চাঁদশী ইউনিয়নের উত্তর চাঁদশী জনকল্যান ক্লাবের উন্নয়নের জন্য ৩০হাজার টাকা (প্রকল্প নং-৫৫) চাঁদশী ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক শান্তি রঞ্জন সোম প্রকল্প চেয়ারম্যান হিসেবে কমিটি দাখিল করে জনকল্যান ক্লাবের টাকা তুলে আত্মসাত করেছেন বলে এলাকাবাসি অভিযোগ করেন। অভিযোগের ব্যাপারে শান্তি রঞ্জন সোম বলেন, ভূয়া নয়, আমার বাড়িতে এ ক্লাবের কার্যক্রম চলছে। তবে তার বাড়িতে গিয়ে এ সংগঠনের  কোন অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।

চাঁদশী মোনাচ্ছেদ সরদারের বাড়ির মসজিদ উন্নয়নে ৩০ হাজার টাকা বরাদ্ধ করা হয় (প্রকল্প নং-৬২)। মোনাচ্ছেদ জানান, আমার বাড়িতে কোন মসজিদ নেই, আমাকে প্রকল্প চেয়ারম্যান করা হলেও আমি কিছুই জানিনা। কে বা কারা আমার নামে টাকা তুলে আত্মসাত করেছে। গৌরনদী পৌরসভার ৭নং ওয়ার্ডের আশোকাঠী সুর্য্য তরুন সংঘ (প্রকল্প নং ৪৮) ও আশোকাঠী সমাজ সেবা অফিসের (প্রকল্প নং ৪৯) নামে দুটি প্রকল্প দাখিল করে ৭০ হাজার টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। এলাকাবাসি জানান, এ নামে এলাকায় কোন প্রতিষ্ঠান নেই। ওই ওয়ার্ডের পৌর কাউন্সিলর ও পৌর যুবলীগের যুগ্ম আহবায়ক এস.এম ফিরোজ রহমান জানান, এ ওয়ার্ডে ওই দুটি সংগঠনের কোন অস্তিত্ব নেই।

সরিকল ইউনিয়নের হোসনাবাদ টেম্পু ষ্ঠান্ডের মসজিদ উন্নয়নের নামে স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতা মোঃ গোলাম সরোয়ার ৩০ হাজার টাকা তুলে নেন। মুক্তিযোদ্ধা মেজবা উদ্দিনসহ টেম্পুষ্টান্ডের ব্যবসায়ীরা জানান, এখানে কোন মসজিদ নেই। মাহিলাড়া ইউনিয়নের শরীফাবাদ গ্রামের শেখ আরিফ শরীফের মাজার মসজিদের ছাদ নির্মান (প্রকল্প নং -৮৬) প্রকল্প চেয়ারম্যান হিসেবে মাহিলাড়া ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক মোঃ আবুল কালাম ৩০ হাজার টাকা তুলেছেন। ওই একই নামে ভিন্ন প্রকল্পে দাখিল করে (প্রকল্প নং-২৪) মাহিলাড়া ৬নং ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের সভাপতি মোঃ চাঁন মিয়া প্রকল্প চেয়ারম্যান হিসেবে ৩০ হাজার টাকা  নিয়েছেন। স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, একই প্রতিষ্ঠানের নামে দুটি প্রকল্প দেখিয়ে দুই নেতা ৬০ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।

গৌরনদী পৌরসভার ৪নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা সাবেক সহকারী পুলিশ সুপার শান্তুনু ঘোষের বাড়ির মনসা মন্দির সংস্কার প্রকল্পে ৩০ হাজার টাকা বরাদ্ধ করা হয়। মন্দির কমিটির সভাপতি ও সাবেক সহকারী পুলিশ সুপার শান্তুনু ঘোষ জানান, তার মন্দিরে একটি টাকাও দেয়া হয়নি। আমার নাম ব্যাবহার করে টাকা তুলে নেয়া হয়েছে।

গৌরনদী উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের প্রকল্প এলাকার বাসিন্দারা জানান, প্রতিটি ইউনিয়নেই কাগজে প্রকল্প থাকলেও বাস্তবে অধিকাংশ প্রকল্প নেই। গৌরনদী উপজেলা ত্রান ও পূর্নবাসন কর্মকর্তা মোঃ কবির উদ্দিনের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের কাছে কোন অভিযোগ আসেনি। অভিযোগ পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। গৌরনদী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামীলীগ নেতা মোঃ শাহ আলম খানের কাছে অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, টি.আর নগদ টাকার প্রকল্প সম্পর্কে আমি অবহিত নই। তাছাড়া কোন অভিযোগও পাইনি।

খোকন আহম্মদে হীরা-গৌরনদী ডটকম