আর কতো প্রাণ গেলে-কতো লোক পঙ্গু হলে-ভটভটি নসিমন বন্ধ হবে

ও করিমন মহাসড়কসহ জনগুরুতপূর্ণ সড়কে চলাচল বন্ধ হবে। সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরসহ স্থানীয় প্রসাশনের কাছে এ প্রশ্ন এখন সচেতন মহলের। অদক্ষ ড্রাইভার দিয়ে এ ভটভটি নসিমন গাড়ি চালানোর ফলে মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে বরিশাল-ঢাকা মহাসড়কসহ পাশ্ববর্তী জনগুরুতপূর্ণ সড়কে মর্মান্তিক সড়ক দূর্ঘটনায় ১৯ জন নিহত ও প্রায় অর্ধশত লোক হয়েছেন আহত। এদের মধ্যে অনেকেই আবার নাম লিখিয়েছেন পঙ্গুত্বের খাতায়। কেউ বা এখনও মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন ঢাকা হাসপাতালে।
সর্বশেষ গত ২৫ অক্টোবর এ অবৈধ ভটভটি নসিমনের ধাক্কায় গুরুতর আহত হয়ে অকালেই প্রান হারাতে হয়েছে গৌরনদীর একতা ভাড়ায়চালিত মোটর সাইকেল সমবায় সমিতির সদস্য ও আগৈলঝাড়া উপজেলার পূর্ব পতিহার গ্রামের মাষ্টার ওহাব আলী কাজীর পুত্র মিজানুর রহমান মোল্লাকে (৩০)। এসময় আরো আহত হয়েছেন মহিলাসহ ২ জন। আগৈলঝাড়া উপজেলার রতপুর বাজার সংলগ্ন এলাকায় ২৫ অক্টোবর ভোর সাড়ে ছয়টার দিকে বেপরোয়াগতিতে আসা নসিমনের ধাক্কায় মোটরসাইকেলসহ চালক মিজানুর রহমান ও আরোহী দু’জন ছিটকে পরে গুরুতর আহত হন। মুমুর্ষ অবস্থায় মিজানকে প্রথমে গৌরনদী ও তাৎক্ষনিক ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পথিমধ্যে ওইদিন সন্ধ্যায় সে (মিজান) মারা যায়। মিজানের মৃত্যুর খবরে তার পরিবারসহ পুরো গৌরনদীতে শোকের ছায়া নেমে আসে।
এ ঘটনার মাত্র ১০দিন পূর্বে (১৫ অক্টোবর) মহাসড়কের আশোকাঠী ফিলিং ষ্টেশনের সম্মুখে বসে বেপরোয়াগতিতে আসা নসিম ট্রলির ধাক্কায় গুরুতর আহত হয়ে বর্তমানে ঢাকার শমরিতা হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন গৌরনদী প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি মোঃ গিয়াস উদ্দিন মিয়া (৩৬)। সংবাদ সংগ্রহের কাজে বেরিয়ে তিনি এ দূর্ঘটনার স্বীকার হন। সাংবাদিক গিয়াস উদ্দিন মিয়া গত ১৫ অক্টোবর সকাল এগারোটার দিকে সংবাদ সংগ্রহের জন্য গৌরনদী প্রেসক্লাব থেকে বাটাজোরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। পথিমধ্যে মহাসড়কের আশোকাঠী ফিলিং ষ্টেশনের সম্মুখে পৌঁছলে বিপরীতদিক থেকে আসা ডিজেল চালিত মালবাহী নসিমন ট্রলি নিয়ন্ত্রন হারিয়ে বেপরোয়াগতিতে মোটরসাইকেলের ওপর এসে পরে। এতে মোটরসাইকেলের সম্মুখ ভাগ দুমরে মুচরে যায়। স্থানীয়রা মুমুর্ষ অবস্থায় সাংবাদিক গিয়াস উদ্দিনকে উদ্ধার করে গৌরনদী হাসপাতালে ভর্তি করে। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে তাৎক্ষনিক তাকে ঢাকা হাসপাতালে প্রেরন করা হয়। বর্তমানে তিনি ঢাকার শমরিতা হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন।
এ ঘটনার ১০ দিন পূর্বে (৫ অক্টোবর) মহাসড়কের গৌরনদীর তাঁরাকুপি নামকস্থানে বরযাত্রীবাহি নছিমন দূর্ঘটনায় ৩ জন নিহত ও বর-কনেসহ কমপক্ষে ১৫ জন আহত হয়। গৌরনদী হাইওয়ে থানার ইনচার্জ মোজাম্মেল হোসেন জানান, গৌরনদী উপজেলার কমলাপুর গ্রামের মৃত মতলেব বেপারীর কন্যা পারভীন আক্তারকে বিয়ে করে বর হানিফ ফকির নসিমনযোগে বরযাত্রীসহ তার উজিরপুরের কালিহাতা গ্রামের বাড়িতে ফিরছিলেন। পথিমধ্যে মহাসড়কের তাঁরাকুপি মহব্বত আলী বেপারীর বাড়ির সন্নিকটে পৌঁছলে বরযাত্রীবাহি নসিমনটি দূর্ঘটনা কবলিত হয়। এতে ঘটনাস্থলেই বর হানিফের চাচী হোসনেআরা বেগম (৩৫), চাচাতো বোন নাছিমা বেগম (২৫) ও বরিশাল হাসপাতালে নেয়ার পথে ভাগ্নি ফাতেমা (১২) মারা যায়। এছাড়া গুরুতর ভাবে আহত হয় বর-কনেসহ আরো ১৫ জন। 
এছাড়াও গত ৮ মার্চ ডিজেলচালিত নসিমনের চাকায় পৃষ্ঠ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যায় আগৈলঝাড়া উপজেলার সেরাল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেনীর মেধাবী ছাত্র মোঃ রুবেল হোসেন (১৪)। এ ঘটনায় বিক্ষুব্দ গ্রামবাসি ও স্কুলের শিক্ষার্থীরা ঘাতক নসিমনে অগ্নিসংযোগ করে পুরিয়ে দেয়। ওই সময় বিক্ষুব্ধরা অবৈধ নসিমন বন্ধের দাবিতে দফায় দফায় বিক্ষোভ মিছিলও করেছিলেন। পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে বিক্ষুব্ধদের শান্ত করেন। সূত্রমতে, ওই স্কুলের অষ্টম শ্রেনীর মেধাবী ছাত্র ও কাজীরহাট গ্রামের জনৈক সুলতান আহম্মেদের পুত্র রুবেল হোসেন স্কুলে ছুটির পর বিকেল তিনটার দিকে বাড়ি ফিরছিলো। পথিমধ্যে মাহিলাড়া-সেরাল সড়কের সেরাল নামকস্থানে অবৈধ নসিমন বেপরোয়াগতিতে যাওয়ার সময় স্কুল ছাত্র রুবেলকে চাপা দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই রুবেল মারা যায়।
ওই মাসেরই ৪ তারিখ নসিমনের ধাক্কায় মারা গেছেন আগৈলঝাড়া উপজেলার পয়সারহাট বন্দরের ব্যবসায়ী ও মোটরসাইকেল চালক নজরুল ইসলাম (২২)। মর্মান্তিক এ ঘটনাটি ঘটেছিলো সাহেবরামপুর বাজার সংলগ্ন এলাকায়। গৈলা ইউনিয়নের সাবেক ভাইসচেয়ারম্যান শ্যাম বেপারীর পুত্র ও পয়সারহাট বন্দরের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম ব্যবসায়ীক কাজে ওইদিন সকালে নিজবাড়ি দক্ষিণ শিহিপাশা থেকে কালকিনির সাহেবরামপুর বাজারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। পথিমধ্যে টরকী-সাহেবরামপুর সড়কের সাহেবরামপুর বাজারের সন্নিকটে পৌঁছলে বিপরীতদিক থেকে আসা নসিমন তাকেসহ তার মোটরসাইকেলকে স্ব-জোরে ধাক্কা দেয়। এতে মোটর সাইকেলটি দুমরে মুচরে ব্যবসায়ী নজরুল গুরুতর আহত হয়। মুুমর্ষ অবস্থায় তাকে কালকিনি হাসপাতালে নেয়ার পর কর্ত্যরত চিকিৎসক মৃত বলে ঘোষনা করেন। এরকিছুদিন পূর্বে গৌরনদী বন্দর সংলগ্ন টিকাসার তুলাতলা নামকস্থানে নসিমনের চাকায় পৃষ্ট হয়ে এক বৃদ্ধ মারা গেছেন। ওই ঘটনার এক সপ্তাহ পূর্বে সরিকল এলাকায় নসিমন দুর্ঘটনায় আহত হয়েছে ৫ জন ধানকাটা শ্রমিক। 
গৌরনদীতে এ ভটভটি নসিমন দূর্ঘটনার খবর প্রতিদিনেই কম বেশি রয়েছে। তবে এরমধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনাটি ঘটেছিলো ২০০৮ সালের ১৪ মার্চ ভোরে। ওইদিন ভোর ছয়টার দিকে মহাসড়কের মাহিলাড়া বেজহার নামকস্থানে বরযাত্রীবাহি নসিমন দূর্ঘটনায় একই পরিবারের চারজনসহ ঘটনাস্থলেই ১২ জন নিহত ও কমপক্ষে ২০ জন আহত হয়েছিলো। সূত্র মতে, গৌরনদী উপজেলার বাটাজোর বাইচখোলা গ্রামের রবীন্দ্রনাথ মন্ডলের কন্যা বিউটির সাথে ২০০৮ সালের ১৩ মার্চ সামাজিক ভাবে বিয়ের দিন ধার্য্য হয় আগৈলঝাড়া উপজেলার বড়মগরা গ্রামর রমেশ শিকারীর পুত্র রমেন শিকারীর। হিন্দু ধর্মের বিবাহ অনুষ্ঠান। তাই রাতভর বিয়ের অনুষ্ঠান শেষে ১৪ মার্চ ভোরে নববধূকে নিয়ে নসিমনযোগে বরযাত্রীরা বড়মগরার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। পথিমধ্যে গৌরনদী উপজেলার মাহিলাড়ার বেজহার নামকস্থানে বরযাত্রীবাহি নসিমনটি দূর্ঘটনাকবলিত হয়। এতে একই পরিবারের ৪ জনসহ ১২জন নিহত, বর ও নববধূসহ কমপক্ষে ১৫ জন আহত হয়।
অপরদিকে ২০০৭ সালের ১৪ জুলাই গৌরনদীর কসবা নামকস্থানে নসিমন দূর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরন করেছে আগৈলঝাড়া উপজেলার ভালুকশী গ্রামের ইসাহাক আলী খানের একমাত্র পুত্র যুবলীগ কর্মী রবিউল ইসলাম খান (৩০)। অর্থাভাবে রবিউল ভালো কোন হাসপাতালে চিকিৎসা পর্যন্ত নিতে পারেননি। চিকিৎসকরা বলেছিলেন দ্রুত ভাবে রবিউলকে ভারতের মাদ্রাজে নিয়ে চিকিৎসা করানো হলে তাকে পঙ্গুত্বের হাত থেকে বাঁচানো সম্ভব হবে। কিন্তু এতটাকা যোগাড় করা তার অসহায় পরিবারের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়েছে। তাই বাধ্য হয়েই তরতাজা যুবক রবিউলকে নাম লেখাতে হয়েছে পঙ্গুত্বের খাতায়। এছাড়াও এখানে আরো অসংখ্য নসিমন দূর্ঘটনার ইতিহাস রয়ে গেছে। 
এভাবে আর কতো রবিউল পঙ্গুত্ব বরন করলে, আর কতো মিজান অকালে প্রাণ দিলে এ ডিজেলচালিত অবৈধ ভটভটি নসিমন চলাচল বন্ধ হবে। সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরসহ স্থানীয় প্রসাশনের কাছে এ প্রশ্ন এখন সচেতন মহলের।
স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের উদ্যোগে মাঝে মধ্যে লোকদেখানো ভাবে কয়েকটি নসিমন আটক করা হলেও কয়েকদিন পরেই আবার বিভিন্ন শর্ত জুড়ে দিয়ে ওইসব আটককৃত নসিমনকে ছেড়ে দেয়া হয়। কিছুদিন যেতে না যেতেই স্থানীয় প্রশাসনকে বৃদ্ধাঅঙ্গুলি দেখিয়ে সকল শর্ত ভন্ডুল করে মহাদাপটের সাথে মহাসড়ক দিয়ে পাল্লা দিয়ে চলছে এসব অবৈধ নসিমন।
কেন এতো নসিমন দূর্ঘটনা? এক বিশেষ অনুসন্ধানে বেড়িয়ে এসেছে এর চাঞ্চল্যকর তথ্য। তথ্য মতে, অধিকাংশ নসিমন চালকই হচ্ছেন রিকসা কিংবা ভ্যান চালক। কেউবা হচ্ছেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ উত্তোলন করেই অধিক আয়ের লোভে ইঞ্জিন চালিত একটি নসিমন ক্রয় করেই ২/১দিন প্রশিক্ষনের পরেই নেমে পরেছেন মহাসড়কে। এ নসিমন গাড়ির ব্রেক খুবই কম। যেখানে গাড়িটি থামানো হবে ঠিক তার এক থেকে দেড়’শ হাত দুরত্বে বসে এ গাড়ির ব্রেক চেপে ধরতে হয়। যার ফলে দূর্ঘটনা স্থলে ব্রেক করতে না পারার কারনেই এসব ইঞ্জিনচালিত নসিমনের দুর্ঘটনা বেড়েই চলছে। এছাড়া এসব নসিমন রাতে চলাচলের জন্য উপযোগী নয়। কারন এসব গাড়ির নেই কোন সিগন্যাল বাতি, নেই সাইড লাইট কিংবা এন্টিকাটার বাতি। প্রথমে দূর থেকে দেখলে মনে হয় একটি মটরসাইকেল। কিন্তু কাছে গিয়ে দেখা যায় এটা মটরসাইকেল নয় এটি হচ্ছে মরন গাড়ি নসিমন। যার কারনেও প্রতিনিয়ত নসিমন দূর্ঘটনা কবলিত হচ্ছে।        
গৌরনদী হাইওয়ে থানার সূত্র মতে, গৌরনদীতে প্রায় ৩’শ নসিমন চলাচল করছে। কিন্তু থানা পুলিশের হিসেবের চেয়ে প্রায় দ্বিগুন নসিমন প্রতিদিন মহাসড়ক দিয়ে মহাদাপটের সাথে দুরপাল্লার বাসসহ অন্যান্য যানবাহনের সাথে পাল্লা দিয়ে মালামাল ও যাত্রী বোঝাই করে চলাচল করতে গিয়েই প্রতিদিন দুর্ঘটনার স্বীকার হচ্ছে। এসব ভটভটি নসিমন প্রতিদিন যে ভাবে পরিবেশ দূষন করছে, তেমনি প্রতিদিন দূর্ঘটনার ঘটনাও বৃদ্ধি করে দিয়েছে। দ্রুত ভাবে এসব ভটভটি নসিমন বন্ধের জন্য সচেতন মহল সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরসহ স্থানীয় প্রশাসনের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
– খোকন আহম্মেদ হীরা
সম্পাদক