“মইত্তা রাজাকারগো ফাঁসি দেইখা মরতে চাই”

ভেঙ্গে পরছিলেন, আর আঁতকে ওঠেন ভয়ে। একে একে বলেন সেই বিভিষিকাময় দিনগুলির কথা, তার ভাসুর পুত্র ফ্যান্সিস হালদার দেশ শত্র“মুক্ত করার জন্য মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করেন। এ খবর স্থানীয় রাজাকাররা গৌরনদী কলেজ ক্যাম্পে থাকা পাকহানাদারদের জানানোর পরে তারা (পাক সেনারা) ক্ষিপ্ত হয়ে ফ্যান্সিসকে খোঁজার জন্য ১৯৭১ সালের ২রা আষাঢ় দু’টি ¯প্রীট বোর্ডযোগে দুপুর সাড়ে বারোটার দিকে তাদের খ্রীষ্টান পল্লীতে হানা দেয়। পাক সেনাদের কথাশুনে বাড়ির লোকজন ভয়ে এদিক সেদিক ছোটাছুটি শুরু করেন। তখন তিনি (মারিয়া) দুপুরের রান্না করছিলেন। পাকসেনারা তাদের পল্লীতে ঢুকেছে এ কথাশুনেই তিনি তার ৩ পুত্র ও ২ কন্যাকে নিয়ে বাড়ির পাশ্ববর্তী বিশাল বাগানে পালিয়ে থাকেন।
পাক সেনারা ফ্যান্সিসকে না পেয়ে তার (মারিয়ার) স্বামী সামূয়েল হালদার, ১৩ বছরের পুত্র মুকুল হালদার, ভাসুর হরলাল হালদার, নরেন্দ্র নাথ হালদার, ভাসুর পুত্র টমাস হালদার, আগাষ্টিন হালদার, বিমল হালদার, দানিয়েল হালদার ও সুকুমার হালদারকে ¯প্রীটবোর্ডে তুলে নিয়ে যায় পাশ্ববর্তী বাকাল হাটের কাছে। সেখানে নিয়ে হত্যার উদ্দেশ্যে একে একে নয়জনকেই গুলি করে পাকহানাদাররা। সেই গুলিতে সাতজন শহীদ হলেও ভাগ্যক্রমে গুলিবিদ্ধ হয়েও প্রানে বেঁচে যায় মারিয়ার বড়পুত্র মুকুল হালদার ও ভাসুর পুত্র সুকুমার হালদার। বছর চারেক পূর্বে সুকুমার হালদার মারা যান। পঙ্গু অবস্থায় আজও বেঁচে আছেন মুকুল হালদার। ওইসময় এ হত্যাযজ্ঞের খবর এলাকায় ছড়িয়ে পরলে এলাকাবাসির মধ্যে আতংক দেখা দেয়। কয়েক ঘন্টার মধ্যেই ওইএলাকা জনশূন্য হয়ে পরে। খবর পেয়ে মারিয়া হালদারসহ বাড়ির অন্যান্য মহিলারা মিলে দুইদিন পর পাকবাহিনীর গুলিতে নিহত ৭ শহীদদের লাশ পানি থেকে উদ্ধার করেন। পরবর্তীতে তারা বাড়ির পার্শ্বে একটি কুপ খনন করে লাশ গুলোকে একত্রে সেইকুপে মাটি চাপা দিয়ে রাখেন।
দেশ স্বাধীনের পর বহুকষ্টে সংসারের হাল ধরেন মারিয়া। জীবন যুদ্ধে তিনি বাড়িতে বসে মুড়ি ভেজে পায়ে হেঁটে টরকী বন্দরে গিয়ে বিক্রি ও বিভিন্ন হাট-বাজারের হোটেল রেস্তোয়ার পানি টেনে উপার্জিত অর্থ দিয়ে ছেলে-মেয়েদের মুখের আহার জুগিয়েছেন। আক্ষেপ করে বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের দীর্ঘদিন অতিবাহিত হওয়ার পরেও তাদের খ্রীষ্টান পল্লীর ৭ শহীদের গনকবরের খবর কেউ নেয়নি। এমনকি শহীদ পরিবার হিসেবেও তারা কোন মর্যাদা পাননি।
২০০৪ সালে স্থানীয় বেসরকারি সমাজসেবী সংগঠন আলোর শিখা’র পরিচালক জেমস মিদুল হালদারের উদ্যোগে ৭ শহীদের স্মৃতি রক্ষার্থে গনকবরের ওপর স্মৃতি সৌধ নির্মান করা হয়। প্রতি বছরের ২ রা আষাঢ় শহীদদের স্মরনে স্মৃতি সৌধর সম্মুখে প্রার্থনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
স্বামীর ছবি বুকে নিয়ে মারিয়া হালদার আজো কাঁদেন। কান্নাজড়িত কন্ঠে তিনি বলেন,  স্বামী ও স্বজনদের হারিয়েও দেশটা যে স্বাধীন হয়েছে এই আমাদের গর্ব। তবে, ওই সময়ে পাকসেনাদের সহযোগী মইত্তা রাজাকারগো এখনও যে বিচার হয়নি এটাই বড় দুঃখ। মরার আগে ওইসব মইত্তা রাজাকারগো ফাঁসি দেইখা মরতে চাই।