পূণর্মিলন : যুথিকা বড়ুয়া

আর সেইদিনই দৃঢ় সংকল্প নিয়ে মনে-প্রাণে মহুয়াকেই জীবন সঙ্গিনী করতে চেয়েছিল সুপ্রিয়। চেয়েছিল, ওর হৃদয়পটভূমির বিশাল সাম্রাজ্যের সাম্রাজ্ঞী করতে! ওর হৃদয়পদ্মে দেবীর আসনে মহুয়াকে প্রতিষ্ঠিত করতে! যেদিন হৃদয়ের সমস্ত অনুভূতি দিয়ে জীবনে প্রথম অনুভব করেছিল সুপ্রিয়, মহুয়াকে সত্যিই সে ভালোবেসে ফেলেছে। কিন্তু বিধিই বাম! বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো হঠাৎ হৃদয়পটভূমির মহা ঘূর্ণির প্রলয় মাতনে প্রচন্ড অস্খিতিশীলতা দেখা দিতে লাগল। সুপ্রিয়র। পারেনি নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে। পারে নি, হৃদয়গহ্বরে সদ্য রোপণ করা ভালোবাসার বীজ ধারণ করতে। আর পারেনি বলেই তা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে গিয়েছিল! যেদিন তীরের মতো বিদ্ধ হয়ে ওর সুকোমল হৃদয়ে একটা কঠিন আঘাত এসে লেগেছিল। যা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি কোনদিন!

এ কেমন বিধাতার দু’টি মানব-মানবীর সংসার বেঁধে দেওয়ার নিষ্ঠুর অপপ্রয়াস? কেন মরীচিকার মতো মিছে মায়াজালে নিজেকে স্বেচ্ছায় ধরা দিয়েছিল সুপ্রিয়? আর কেনইবা রামধনুর মতো ওর হৃদয়াকাশে আর্বিভূত হয়েই অদৃশ্য হয়ে গেল মহুয়া! সবটাই কি ওর ছলনা, অভিনয়!

হাজার প্রশ্নের ভীঁড়ে জর্জরিত সুপ্রিয়, তিক্ত-বিরক্ত হয়ে নারীজাতির সংস্পর্শ থেকে একেবারে দূরে সরে এসে ছিল! ভুলে গিয়েছিল ওর অতীতকে! ভুলে গিয়েছিল, মহুয়াকেও! যেদিন দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে নিজস্ব গতীতে এগোতে শুরু করেছিল! কিন্তু সত্যিই কি সুপ্রিয় ভুলতে পেরেছিল মহুয়াকে?

( ২ )

সাধারণত: প্রাত্যহিক জীবনে কম-বেশী প্রতিটি মানুষকেই ঘাত-প্রতিঘাতে এক প্রকার সংগ্রাম করেই বেঁচে থাকতে হয়! বিশেষত: যারা মধ্যবিত্ত পরিবারের খেটে খাওয়া মানুষ। যাদের একমাত্র গৃহকর্তার উপাজর্নে সংসার চলে। বটবৃক্ষের ছায়ার মতো নির্ভরশীল, যার স্ত্রী-পুত্র এবং কন্যা! আর সেই ছায়া হঠাৎ জীবন থেকে সড়ে গেলে তখনই গহীন অনুভূতি দিয়ে উপলদ্ধি করা যায়, রৌদ্রের খড়দ্বীপ্তের তাপমাত্রা কতখানি প্রকট! তেমনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে আকস্মিক পিতার মৃত্যুর পর সুপ্রিয়র জীবনে নেমে আসে চরম বিপর্যয়। মাত্র সতেরো বছর বয়সে বজ্রাঘাতের মতো সংসারের সমস্ত দায়-দায়িত্ব-কর্তব্যের ভার এসে পড়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় সুপ্রিয়র মাথার উপর। তাতে মানসিকভাবে পঙ্গু হয়ে পড়লেও জীবন নদীর প্রবাহ কখনো থেমে থাকেনি!

পিতার পরিবর্তে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করবার দায়িত্ব নিয়ে সংসার নামের তড়ীখানা ভাসিয়ে দেয় অনিশ্চিত মোহনার দিকে। অবসরে নিজের পড়াশোনাও অব্যাহত রাখে এবং একাগ্রহে নিরলস সাধনায় নিমগ্ন ছিল, প্রায় সাত বছর! যখন একটানা পাহাড়ের মতো সংসারের ঘানি টানতে টানতে সুপ্রিয়র নি:সঙ্গ জীবনে স্বপ্নপরী মতো কিশোরী কন্যা মহুয়া ধূমকেতুর মতো পতিত হয়ে বিনা নোটিশে উধাও হয়ে গিয়েছিল। যার কারণ অনুসন্ধানে মনের সমস্ত শক্তি যখন হারিয়ে গিয়েছিল, ঠিক তখনিই ঘুরে গেল সুপ্রিয়র ভাগ্যের চাকাটা। যা স্বপ্নেও কল্পনা করেনি কোনদিন!

মিরাকলের মতো প্রথম প্রয়াসেই আশাতীত সাফল্যের একেবারে চরম স্বর্ণশিখরে পৌঁছে যায় সুপ্রিয়। ওকে পিছন ফিরে আর তাকাতে হয়নি! একজন দক্ষ কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। সরাসরি টরন্টো শহরে পোষ্টিং হয়ে জীবনের রঙই বদলে গেল সুপ্রিয়র। বদলে গেল দৈনন্দিন জীবনের কর্মসূচী, ওর জীবনধারা।

কিন্তু শত চেষ্টা করেও পারেনি, মনের রঙ বদলাতে। পারেনি, জীবনকে নতুন করে সাজাতে। আর পারে নি বলেই অর্থ-বিত্ত-ঐশ্বর্য্যে ভরপুর জীবনেও একটা শূন্যতা অনুভব করে সুপ্রিয়! খাঁ খাঁ করে ওঠে বুক! কিন্তু কেন? কিসের অভাব ওর? শান্দার গাড়ি-বাড়ি, ফ্যাশানাবল ফার্ণিচার, ব্যাঙ্ক-বালেঞ্জ সবই পরিপূর্ণ! অথচ সারাদিনের কর্মব্যস্ততার মধ্যেও মনটা সারাক্ষণ উদাস হয়ে থাকে সুপ্রিয়র।

এদেশে রং-এর ছড়াছড়ি। চতুর্দিকে নিত্য-নতুন চমকপ্রদ রঙের বাহার। অথচ কোনো রঙেই সুপ্রিয়র মন মজেনা। ক’দিন যাবৎ ওর সহকর্মী রবিনের দৃষ্টিগোচর হয়, নৈ:শব্দে অফিস ঘরে ঢুকে চেয়ারে হেলান দিয়ে চুপচাপ বসে থাকে। গভীর নিমগ্ন হয়ে কি যেন ভাবে! আর একটার পর একটা সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করে টেনে টেনে ধোঁয়া ছাড়ে।

রবিন মহারাষ্ট্রের ছেলে। কর্মীদের মধ্যে সবার ছোট বয়সে। খুব রসিক। কথায় কথায় হাসায়। সুপ্রিয়র সাথে ভীষণ ভাব। ওর অন্তরঙ্গ বন্ধু। বাংলাও ভালো বলতে পারে বেশ। হঠাৎ সুপ্রিয়কে কাঁপিয়ে দিয়ে বলে, -‘কি গুরু, এতো উদাস কেন! মামলা ক্যায়া হ্যায় ভাই! কিসিসে ইস্ক হো গয়া হ্যায় ক্যায়া!’

ধপ্ করে সোফায় বসে বলে, -‘হুঁম:, ইস্ক, ওভি তুমসে! কভি নেহি! জড়া হিম্মত চাহিয়ে প্রিয়দা!’

মুখ টিপে একটা বিষন্ন হাসি হেসে সুপ্রিয় বলল,-‘ভালোবাসার ফুল ফুটতে দেখেছিস কখনো?’

কথাটা এমনভাবে বলল, যেন একজন শিক্ষক তার ছাত্রকে প্রশ্ন করছে!

রবীন হো: হো: করে হেসে ওঠে! হাসিটা বজায় রেখে বলল,-‘ভালোবাসার ফুল! ওতো হর রোজ দেখতি হুঁ ম্যায়! লেকিন তুমি এ চক্করে পড়লে কবে গুরু!’

মুহূর্তেই বিষন্নতায় ছেয়ে গেল সুপ্রিয়র শরীর ও মন! ফোঁস করে একটা দীর্ঘ নি:শ্বাস ছেড়ে কি যেন ভাবল ও’। অন্যমনস্ক হয়েই একটা সিগারেট বের করল পকেট থেকে। তাতে অগ্নি সংযোগ করে লম্বা একটা টান দিলো। একগাল ধোঁয়া ছেড়ে বলল, -‘শুধু তাই-ই নয়রে রবি, ভালোবাসার ফুল ফুটে ঝড়েও যেতে দেখেছি আমি!’

রবিন যেন আকাশ থেকে পড়ল শুনে। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায় চেয়ার থেকে। একরাশ কৌতূহল আর বিস্ময় নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ হাঁ করে চেয়ে থাকে। সুপ্রিয়র আপাদমস্তক নজর বুলিয়ে বলল,-‘তোমার আজ কি হয়েছে বলো তো গুরু! ভূতের মুখে রাম নাম! কখনো তো তোমায় ঐ গলিতে পা রাখতে দেখিনি! তুমিই না বলেছিলে, নারীর সংস্পর্শ পুরুষদের জন্য সর্বদা লাভজনক নয়! যদি সে ছলনা করে! আর তাদের তুমি হেট করো!’

হাতের কনুই দিয়ে সুপ্রিয়র পেটে একটা গুঁতো মেরে বলে,-‘কিউ জনাব, আখির হো গয়া না! কবসে চল রাহা হ্যায় ইয়ে শিলশীলা! তুমি তো বড় গভীর জলের মাছ প্রিয়দা! পেটে ক্ষিদে মুখে লাজ, এ্যাঁ! বলি কোন্ বর্শিতে ধরলে! ভেরী ইন্টারেষ্টটিং!’

পরক্ষণেই রবিন সিরিয়াস হয়ে বলে,-‘আরে ছাড়ো তো! মরদ লোকের এতো ভাবনা কিসের! মেয়ে মানুষের অভাব আছে না কি! বলো তো আমিই ফিট্ করে দিচ্ছি!’

গম্ভীর হয়ে সুপ্রিয় বলল,-‘এ্যাই, ফাইজলামি করিস না! বসে বসে আড্ডা দিচ্ছিস! কোনো কাজ নেই তোর! ম্যানেজারের কানে গেলে, দেবে কিন্তু বারোটা বাজিয়ে!’

রবিনের গায়ে জোরে একটা ধাক্কা দিয়ে বলে, -‘তুই এখন যা! লাঞ্চ আওয়ারে আসিস!’

কথাটা শেষ না হতেই টেলিফোনটা ঝন্ঝন্ করে বেজে ওঠে। রবিন দ্রুত রিসিভারটা তুলেই বলল,-‘হ্যালো’!

ওপাশ থেকে ভেসে এলো মহিলা কণ্ঠস্বর। -‘হ্যালো’

রিসিভারটা তক্ষুণি হাতে চেপে ধরে রবিন। ভ্রু উত্তোলণ করে ফিস্ফিস্ করে বলল,-‘গুরু, কন্যা কুমারী! নও, শীগ্গির ধরো!’

রবিনের হাত থেকে রিসিভারটা চট্ করে টেনে নিয়ে সুপ্রিয় বলল,-‘ইয়েস, ক্যান আই হেল্প ইউ?’

হাঁপাতে হাঁপাতে জনৈক মহিলাটি বলল,- ‘মিস্ জুলি ইস দেয়ার, স্যার?’

-‘নো ম্যাম, উই আর অল মেল ওয়ার্কার হেয়ার!’

-‘হোয়াট?’

-‘ইয়েস ম্যাম! মে আই নো, ইওর নেইম, এ্যাড্রেস এ্যান্ড টেলিফোন নাম্বার?’

বিস্মিত কণ্ঠে মহিলাটি বলল,-‘নেইম, এ্যাড্রেস, টেলিফোন নাম্বার! হোয়াট ডু ইউ মিন? রাবিশ! আই এ্যাম নট যোকিং!’

মৃদু হেসে সুপ্রিয় বলল,-‘আই নো ম্যাম! বাট উই নিড ইট! ইট ইস আওয়ার ডিউটি!’

বিব্রোত কণ্ঠে মহিলাটি বলল, -‘ফর হোয়াট?’

-‘ম্যাডাম, দিস ইস আওয়ার সীষ্টেম!’

-‘হোয়াট ননসেন্স!’

একেই মহিলা কণ্ঠস্বর! তন্মধ্যে অহেতুক অজ্ঞাত মহিলার রূঢ় ব্যবহারে মুখখানা ফ্যাকাশে হয়ে গেল সুপ্রিয়র! সামান্য চটে গিয়ে কর্কশ স্বরে বলল,-‘ম্যাডাম, কাম টু দি পয়েন্ট!’

এতক্ষণে একটু নরম পড়ে গেল মহিলাটি। মার্জিত হয়ে বলল,-‘আই এ্যাম মিস্ মহুয়া কলিং, ফন্সম…!’

-‘ও.কে, ফাইন! গিভ মি ইওর এ্যাড্রেস এ্যান্ড ফোন নাম্বার!’ সুপ্রিয় বলল।

তৎক্ষণাৎ গলার স্বর বিকৃতি করে মহিলাটি বলল, -‘ও: গড্, ইউ আর রিয়েলি ষ্টুপিড ম্যান!’

অপ্রস্তত সুপ্রিয় হঠাৎ থতমত খেয়ে গেল। মনে মনে অপদস্খ হলো। ওর চোখে চোখ পড়তেই নি:শব্দে হেসে ফেলল রবিন। মৃদুস্বরে বলল,-‘কি হলো প্রিয়দা, খামোশ কিউ!’

অস্বস্তিবোধ করল সুপ্রিয়। ক্রোধ সম্বরণ করতে পারল না। একটা ঢোক গিলে অসন্তোষ গলায় বলল,-‘হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট ম্যাম, ক্যান ইউ টেল মী?’

চোখমুখ খিঁচিয়ে বিড়বিড় করে উঠল সুপ্রিয়। বলল, -‘অপদার্থ! কি মুশকিলে পড়া গেল বল্ তো!’

মহিলাটি বলল,- ‘আই ক্যান্ট হিয়ার ইওর ভয়েস! ইস ইট্ বিউটি সেলুন?’

কণ্ঠস্বর বিকৃতি করে সুপ্রিয় বলল,-‘নো ম্যাম, ইট ইস কম্পিউটার ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানী লিমিটেড! রং নাম্বার!’

-‘ও: শীট্!’ বলে লাইনটা তক্ষুণিই কেটে দিলো মহিলাটি।

রিসিভারটা হাতে নিয়ে তখনও দাঁড়িয়ে ছিল সুপ্রিয়। অহেতুক বিড়ম্বণায় ভীষণ রাগ হলো ওর মনে মনে। রিসিভারটা ধপ্ করে রেখে সিগারেটের বাকি অংশটা ছুঁড়ে ফেলে দেয় গার্বেজে। আর রাগটা গিয়ে পড়ল রবিনের ওপর। -‘কি রে, গেলি না তুই. এখনো বসে আছিস! ডাকবো মিষ্টার রয়কে!’

রবিন বেরিয়ে যেতেই সুপ্রিয় ধপাস করে বসে পড়ল সোফায়। ক্ষণপূর্বের অপরিচিত মহিলার শ্রুতিকটূ তীক্ষî কণ্ঠস্বর বিষ ক্রিয়ার মতো ওকে বারবার দংশণ করতে লাগল। মস্তিস্কের সমস্ত স্নায়ূকোষেও রক্তের স্রোতের মতো সঞ্চালণ হতে লাগল।

ফিরে যায় নিজের কাজে। কিন্তু কিছুতেই মন বসেনা! প্রচন্ড ভাবিয়ে তোলে, কে এই মহিলা? মহুয়া মেয়েটি কে? আবার পরক্ষণেই ভাবে, না না, তাই-বা কেমন করে সম্ভব!

( ৩ )

অফিস ছুটির পর প্রায় প্রতিদিনই কিছু টুকিটাকি গ্রোসারী শপিং সেড়ে বাড়ি ফেরে সুপ্রিয়! কিন্তু আজ ওর তেমন কোনো প্রয়োজন ছিলনা! তবু কি মনে করে ডেনফোর্থ রোডটা ক্রশ করতেই ভাবল, না: একবার ঘুরেই আসি গিয়ে! ঝিঙে-পটলের দাম যে হারে বাড়ছে, একেবারে আগুন! টাচ্-ই করা যায়না! দেখি, টাটকা শাক-সব্জী কিছু পাওয়া যায় কি না!

এই ভেবে ডেনর্ফোথ রোডের ধারে গাড়ি পার্ক করতেই হঠাৎ কার যেন পলকমাত্র দৃষ্টিপাতে বুকটা কেঁপে উঠল সুপ্রিয়র! অনিচ্ছা সত্ত্বেও অবাধ্য চোখের দৃষ্টি আর্কষণ করলো সেদিকে! আর তক্ষুণি স্বগতোক্তি করে উঠল, -‘আরে, মহিলাটিকে তো খুব চেনা চেনা লাগছে! কোথায় যেন দেখেছি! সেই শুভ্র মসৃণ, সুদর্শণা, লাবণ্যময়ী চেহারা! নিখুঁত কোমড়ের গড়ন, উজ্জ্বল বুদ্ধিদীপ্ত ডাগর চোখের চাহনি! কি আশ্চর্য্য, টোলপড়া গোলাপ গালের সেই রহস্যাবৃত দুষ্টুমিষ্টি হাসি!

জনৈক মহিলার বাঁ-পাশের গজ্দন্তটিও নজরে এড়ায় না সুপ্রিয়র! এক সুদর্শণা শ্বেতাঙ্গ তরুণীর সাথে অন্তরঙ্গ আলাপনে মর্শগুল হয়ে আছে! কিন্তু এমন চঞ্চল প্রাণবন্ত, ছন্দময় পদচারণা, কে এই মহিলা! মহুয়া নয়তো!’

ভাবেতই সুপ্রিয়র মনে পড়ে যায়, ওর অতীত জীবনের কিছু অম্লান স্মৃতির কথা! সে যেন হঠাৎ রঙ্গিন বসন্তের ছোঁয়ায় এক নিবেদিত প্রাণ! অত্যাশ্চর্য্যময় এক অভিনব অনুভূতি! যা হৃদয়পটে ধারণ করার আগেই অনাদরে অবহেলায় আবর্জনার মতো চাপা পড়ে গিয়েছিল, ওর স্মৃতির খাতার পাতায়।

সুপ্রিয়র আজও মনে পড়ে, একদিন মহুয়াই কথা প্রসঙ্গে গর্ব করে বলেছিল, সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত ও সুপরিচিত একজন বিশিষ্ঠ প্রভাব-পতিপত্তিশীল ব্যক্তি ওর পিতৃদেব! প্রচুর অর্থের মালিক! স্বার্থের বিনিময়ে অসাধ্য সাধন করা একমাত্র তার পক্ষেই সম্ভব। যাকে চোখে দেখার সৌভাগ্য হয়নি সুপ্রিয়র। হয়তো সব তারই পরিকল্পিত, ষড়যন্ত্র। কে জানে!

সুপ্রিয়র মতো একজন মিডল ক্লাসের হতভাগ্য দরিদ্রের সংর্স্পশ থেকে চিরতরে বিচ্ছিন্ন করবার তখন এটাই ছিল তার একমাত্র সুগম পথ।

অথচ আজ দীর্ঘদিন পর মহুয়া নামটা মনে মনে উচ্চারিত হতেই সব কেমন এলোমেলো হয়ে গেল সুপ্রিয়র। তবু বিশ্বাস হয়না নিজের চোখদু’টোকে! মনে মনে ভাবে, আজ ওর হয়েছে কি! সেই মর্নিংএ অজ্ঞাত মহিলার ফোন কল্ রিসিভ করার পর থেকে মনের ভিতর বারবার এমন চেতনাইবা আসছে কেন ওর! এরূপ ভাবান্তর আগে তো কোনদিন হয়নি! ওর মতিভ্রম হলো না কি!

ইচ্ছে হচ্ছিল, জনৈক মহিলার সম্মুখে দাঁড়িয়ে কৈফেয়ৎ চাইতে। ওর কাছে জবাবদিহী করতে। ঘটনার প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটন করতে। কি অপরাধ করেছিল সুপ্রিয়? অহেতুক কেন ওর হৃদয়ে এমন কঠিন আঘাত হেনে ওর জীবন থেকে দূরে সড়ে গিয়েছিল মহুয়া? আর কেনইবা ও’ এতকাল আত্মগোপন করেছিল?

কিন্তু না:, যে ভুল একবার সে করেছে, দ্বিতীয়বার আর নয়! তা’ছাড়া পরস্ত্রীও তো হতে পারে! আর যদি নাও হয়, এতকাল পর কিইবা এসে যায় তাতে! সুপ্রিয় কখনো হার মানতে শেখেনি! পুরুষমানুষ হয়ে একজন স্ত্রী লোকের কাছে নত স্বীকার করে ভালোবাসা ভিক্ষে চাইবে! আত্মমর্যাদায় আঘাত করবে! কেন করবে সুপ্রিয়? কিসের জন্যে? নিজেকে কেন সে ছোট করবে? আর প্রশ্রয় দেওয়া নয়! কিছুতেই না! এ মোটেই শোভা পায় না সুপ্রিয়র!

তবু অবুঝ মন কিছুতেই মানতে চায়না সুপ্রিয়র! দ্বিধা আর দ্বন্দ্বের টানাপোড়ণে প্রচন্ড আলোড়ণ সৃষ্টি করে ওর মধ্যে। মরচে ধরা স্মৃতিরা সব এসে ভীঁড় করে চোখের সামনে! কানে বাজে, ভ্রমরের মতো গুনগুন সুরের মহুয়ার মধুর গুঞ্জরণ। হাসি-কলোতান।

সুপ্রিয় পারলো না, নতুন করে ভালোলাগার মধুর আবেশে মনকে ধরে রাখতে। বাধা দিতে। এতো কিছু ঘটে যাবার পরেও আবেগপ্রবণ ভালোলাগা আর ভালোবাসার তীব্র অনুভূতিগুলি এতকাল কোয়ায় যে ওর লুকিয়ে ছিল, পিছন ফিরতেই অস্ফুট একটা খুশীতে বুকটা ভরে গেল সুপ্রিয়র!

অনুমান ঠিকই করেছিল ও’! কিন্তু কখন যে গুটিগুটি পায়ে একটু একটু করে মহুয়ার সন্নিকটে এগিয়ে যাচ্ছিল, টেরই পায়নি! হঠাৎ থমকে দাঁড়ায় সুপ্রিয! চোখ পাকিয়ে দ্যাখে, শরতের শিশির ভেজা সবুজ মখ্মলে ঘাসের প’রে প্রজাপতির মতো ছুটে বেড়ানো সেই দুষ্টুমিষ্টি কিশোরী কন্যা মহুয়া আজ পূর্ণযুবতী। কি শান্ত-স্নিগ্ধ-কোমনীয় ওর রূপ! কি উদ্বিগ্ন যৌবনসম্পন্না অনন্যা! প্রেমের মহিমায় দ্বীপ্ত, মমতাময়ী এক বিদূষী নারী। সেই অবিরল অবয়ব রূপে সশরীরে ষ্ট্যাচুর মতো হাঁ করে চেয়ে আছে জিজ্ঞাস্য দৃষ্টিতে! বিস্ময়ে সেও একেবারে হতবাক। কি যেন বলতে চাইছে!

মহুয়ার আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করে সুপ্রিয় দেখল, ওর রক্তগোলাপ ঠোঁটের কোণে মুক্তঝড়া সেই অনাবিল হাসির ঝিলিকটুকু দৃষ্টিগোচর না হলে ওকে চেনারই উপায় ছিলনা! চেহারার আমূল পরিবর্তন ঘটেছে মহুয়ার! অবিকল দূর্গা প্রতিমার মতো মুখ! হাল্কা মেরুন রঙের শাড়িতে বেশ লাগছে ওকে দেখতে! কপালে ছোট্ট একটা কালো টিপ! শ্বেতাঙ্গদের মতো দুধসাদা গায়ের রঙ, যেন ফেটে পড়ছে! আরো উজ্জ্বল দেখাচ্ছে ওকে! কাতর চোখের দৃষ্টি মেলে কিছু বলার ব্যাকুলতায় ঠোঁটদু’টো ওর কাঁপছে! সেই সঙ্গে লজ্জা আর অব্যক্ত আনন্দের সংমিশ্রণে অশ্রুকণায় চোখের তারাদু’টি ওর মুক্তোর মতো চিক্চিক্ করছে! কিন্তু আজ ওর কিসের অভিনয়? কি জাহির করতে চায় মহুয়া! কি বলতে চায় ও’? কি চায় সে?

মনে মনে প্রচন্ড ক্ষুব্ধ হয় সুপ্রিয়। গুরু গম্ভীর হয়ে ওঠে। ইচ্ছে হচ্ছিল, প্রকাশ্যে জন অরন্যের মাঝে চিৎকার করে বলতে,-‘চিনতে আমিই ভুল করেছিলাম মৌ! তুমি ছলনাময়ী! হাজারটা রূপ তোমার! পুরুষের মন নিয়ে খেলা করাই তোমার মতো লাডলী কন্যার একমাত্র সুখ, আনন্দ। সহৃদয়ে ভালো তুমি কখনোই বাসতে পারো না। প্রকৃত নারী তুমি নও। নারী জাতির কলঙ্ক, ভ্রষ্টাচারী!’

অথচ সুপ্রিয় তা পারল না! পারল না মহুয়াকে আপমান করতে। ওকে অপদস্খ করতে। ওর মাথাটা হেট করে দিতে। ওর নারীত্ব ক্ষুন্ন করে দিতে! বিবেকের দংশণেই নীরব নির্বিকারে সুপ্রিয় সহে গেল ওর বুকের জ্বালা।

মনে মনে বলল,-‘একান্তে নিবিড় করে জীবনে নাইবা পেলাম। ভালোবাসার অপর নামই তো বলিদান। আর নি:স্বার্থে ভালোবাসা জীবনকে দেয় ঐশ্বর্য্য! মনকে করে পবিত্র, প্রভাবিত! আমারা কি বন্ধু হতে পারিনা!’

কিন্তু মানুষের মন বড়ই বিচিত্র! সহজে পোষ মানতে চায়না! সুপ্রিয়র মনের অবস্খাটাও ঠিক তদ্রুপ! খানিকটা ইমোশনাল হয়েই ক্ষীণ কণ্ঠে বলে উঠল,-‘আমায় অযথা দুর্বল করে দিওনা মৌ! একদিন ঠিক এমনি করেই ক্ষণিকের অন্ধমোহে বশীভূত হয়ে আমার মতো সাধারণ একজন অনভিজ্ঞ মানুষ নিজের ষ্ট্যাটাস, সামাজিক অবস্খান ভুলে গিয়ে বেমালুম বদলে গিয়েছিল, নিজের ধ্যান-ধারণা, মন-মানসিকতা! দুইহাতে ছুঁতে চেয়েছিল আকাশের চাঁদ! আসলে সেটা যে মায়া মরীচিকা ছল, চোরাবালির চর! বেদনার উপত্যকায় বসে কল্পনায় শুধু স্বপ্নের জাল বোনা! অথচ হাত বাড়ালে সব শূন্য! কিছুই স্পর্শ করা যায়না! কূয়াশার মতো চারিদিকে ধূসর মরুভূমি! আর তা বোধগম্য হতেই হৃদয় থেকে একেবারে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে আমার আশা-ভরসা, বিশ্বাস আর ভালোবাসা। পারবে, তা ফিরিয়ে দিতে! পারবে, নতুন করে আমায় ভালোবাসতে! বলো মৌ, বলো! জানি, জবাব দেবার মতো আজ তোমার কাছে কিছুই নেই!’

অথচ বুকের ভিতরে কি অসহ্য যন্ত্রণা আজও নির্বিকারে বহন করে চলেছে মহুয়া, সে খবর সুপ্রিয়ই বা জানবে কেমন করে! কেমন করে জানবে, মহুয়ার অপারগতার কথা! ওর ব্যথতার্র কথা! যা কখনোই বিশ্বাস করবে না সুপ্রিয়!

কিন্তু এসব কথা মহুয়া আজ বলবে কেমন করে! নিজেকেই অপরাধী মনে হয়! অথচ মুখ ফুটে একটা শব্দও ওর উচ্চারিত হয়না! ভিতরে ভিতরে মনকে অত্যন্ত পীড়িত করল। মনে মনে বলল,-‘তুমি জানো না সপ্রিয়, মেয়েদের জীবন, হাতে গড়া পুতুলের মতো। যাদের নিজস্ব কোনো ক্ষমতা নেই! অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবার কিংবা প্রতিরোধ করবার মতো সাহস ওদের নেই! কত দুর্বল ওরা! কত অসহায়! ওরা সরীসৃপ প্রাণীর মতো অন্যের উপর নির্ভরশীল! কখনো মুখ ফুটে কিছু চাইতে পারেনা! বলতে পারেনা! আর বলতে পারেনা বলেই অদৃশ্য বিবাহ-বন্ধন সূত্রে সামাজিক স্বীকৃতিকে অপব্যবহার করে, দোকানীর দ্রব্য-সামগ্রীর মতো মোটা কড়ির বিনিময়ে ক্রয়-বিক্রয় হয়, আমার মতো অবলা নারীর জীবন! যেখানে ভালোবাসার কোনো মূল্য নেই! ঠাঁই নেই! এতিমের মতো অনাদর অবহেলায় নি:ভৃতে কেঁদে মরে! শুধু কি তাই, জীবনের পরম আকাáিক্ষত চাওয়া-পাওয়ার স্বপ্ন দেখাও অপরাধ, নিষিদ্ধ। জন্মাবধি মেয়েরা চিরকাল পরাধীনতার শিখলে কারাবন্দী! অগত্যা বোবা অনুভূতির গহীন অনুতাপে দ্বগ্ধ হতে হতেই একদিন নি:শ্ব হয়ে ঝড়ে যায় ফুলের মতো একটি মাসুম জীবন!

কিশোরী বয়স থেকে মাতা-পিতার কঠোর শাসনের সীমাবদ্ধেই আবদ্ধ হয়ে আছি। নিজের ইচ্ছা বা মতামত প্রকাশ করবার স্বাধীনতাটুকুও কোনদিন ছিলনা, আজও নেই! কতবার চেয়েছিলাম, ছুটে গিয়ে শুধু জানাতে, দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছি সুপ্রিয়, তোমার হৃদয় থেকে বহুদূরে। হয়তো কোনদিনও দেখা হবেনা। তুমি বিশ্বাস করো, তখন আমি সম্পূর্ণ নিরুপায়! চার-দেওয়ালের ভিতরে বন্দী! চেয়েছিলাম, বাড়ি থেকে পালিয়ে তোমার হৃদয়গহ্বরে আশ্রয় নিতে। নিজেকে স্বেচ্ছায় সঁপে দিতে! কিন্তু তাও পারিনি! পারিনি এক মুহূর্ত্যরে জন্যেও বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে।’

অথচ আজ, মাত্র কয়েক ফুট দূরত্বের ব্যবধান! কারো মুখে কথা নেই! ক্রমাণñয়ে উষä নি:শ্বাস প্র:শ্বাসের আনা গোনায় সময় বয়ে যায় নীরবে। দুজনেই তন্ময় হয়ে ডুবে গিয়েছে কল্পনায়।

হঠাৎ সুপ্রিয়র চোখে চোখ পড়তেই চোখের পাতাদু’টো সলজ্জে নূয়ে পড়লো মহুয়ার। মনে মনে ভাবলো, কত বদলে গিয়েছে সুপ্রিয়। এতো কি ভাবছে ও’! এখনো কি চিনতে পারছে না! কিন্তু চিনেইবা কি লাভ! সামান্য ক’দিনের সৌজন্যমূলক আন্তরিকতাকে মামুলি বন্ধুত্ব ভেবে ও যে বিনা নোটিশে উধাও হয়ে গিয়েছিল, সেকথা কি ভুলে গিয়েছে সুপ্রিয়, নিশ্চয়ই নয়! অথচ পরিণত বয়সে তা ভালোবাসা নয় বলেও উড়িয়ে দিতে পারেনি! পারেনি, অন্য কোনো পুরুষকে ওর হৃদয়ে দেবতার আসনে ঠাঁই দিতে! চেয়েছিল, সারাজীবন সুপ্রিয়র হৃদয়ে ভালোবাসার ফুল হয়ে ফুটে থাকতে! সুপ্রিয়র পরিচয়েই পরিচিতা হতে, ওর প্রেয়সী হয়ে, ঘরণী হয়ে বেঁচে থাকতে! আজ নির্লজ্জ বেহায়ার মতো সেকথা ও’ বলবে কেমন করে! কিইবা মূল্য আছে তার! কিন্তু এতকাল পর সুপ্রিয়কে এতো কাছে পেয়েও ওকে আবার হারাতে হবে! যদি আর দেখাই না হয় কোনদিন! তা’হলে? সারাজীবন অনুতাপের আগুনে পুড়ে পুড়ে কি নি:শ্ব হয়ে যাবে মহুয়া?

পাত্রপক্ষ আগমন বার্তা পাঠিয়েছে, পরশু রবিবার সন্ধ্যায় পাত্রী দেখতে আসছে। পিতৃদেবের মনোনীত পাত্র। রিজেক্ট করা চলবে না! কোনো কমেন্ট, অপিনিঅন কিছুই চলবে না! কবুল করতেই হবে! তবে এ বিবাহ সে ঠেকাবে কেমন করে! সেই স্পর্ধাও তো মহুয়ার নেই!

নানা দ্বন্দে আর দ্বিধায় কিছুক্ষণের জন্যে অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল মহুয়া। বিচরণ করছিল ওর আপন ভুবনে। হঠাৎ ওর সেই অতি পরিচিত সুপ্রিয়র দরাজ গুরু গম্ভীর কণ্ঠস্বরে চমকে ওঠে। -‘কেমন আছো মৌ! কোথায় ছিলে এতকাল, এ্যাঁ! দ্যাখো তো, কেমন চিনে ফেললাম! ভারি সুন্দর লাগছে দেখতে! কি, চুপ করে আছো, কথা বলবে না! দেখো, আমি কিন্তু কোনো অপরাধ করিনি! অপরাধী আমি নই! বলো সত্যি কি না! কি, বলছ না যে! চুপ করে থেকো না মৌ! কিছু বলো!’

অপ্রত্যাশিত সুপ্রিয়র আবেগমিশ্রিত শ্রুতিমধুর বাক্যশ্রবণে মনটা কেমন উচাটন হয়ে গেল মহুয়ার। কি বলবে, কোথা থেকে শুরু করবে, কিছুই মনস্খির করতে পারেনা। মুখ তুলে সাশ্রু নয়নে নির্বাক দৃষ্টিতে সুপ্রিয়র মুখের দিকে চেয়ে থাকে।

ততক্ষণে ডেনফোর্থের চতুর্দিকে জনসমুদ্রে ছেয়ে গিয়েছে। সব পরিচিত মুখ। আশ-পাশ থেকে ভেসে আসছে বহু পরিচিত মানুষের কণ্ঠস্বর। বুকের ভিতরটা কেমন ধুক্ধ্কু করছে মহুয়ার। সাহসই হচ্ছেনা কিছু বলবার। এক্ষুণি কেউ দেখে ফেললে একটা কেলেঙ্কারী হয়ে যাবে যে!

ভিতরে ভিতরে যে অস্বস্তিবোধ করছে, তা মহুয়ার উদ্ভ্রান্ত চোখমুখে অনায়াসে প্রকাশ পাচ্ছে। পড়ন্ত বিকেলের ক্লান্ত সূর্য্যরে ক্ষীণ রক্তিমাভায় ঘেমে লাল হয়ে গিয়েছে ওর মুখ।

ঝুরুঝুরু মিহিন মৃদু শীতল হাওয়া বইছে। হঠাৎ মহুয়ার শাড়ির আঁচলটা বাতাসের টানে সুপ্রিয়র মুখের উপর উড়ে পড়তেই চোখে চোখ পড়ে গেল সুপ্রিয়র। লক্ষ্য করল, ভয়ে সন্ত্রস্ত্রে আড়ষ্ঠ হয়ে ষ্ট্যাচুর মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে মহুয়া। কি যেন বলতে চাইছে! অথচ বলতেই পারছে না কিছুতেই।

ক্ষণিকের নিরবতা ভঙ্গ করল সুপ্রিয়। শাড়ির আঁচলটা মুখ থেকে সরিয়ে নিয়ে বলল,-‘অযথা ভয় পেওনা মৌ! তোমাকে জবাবদিহী করতে হবেনা। কোনো কৈফেয়ৎই আমি চাইবো না। এদেশে কবে এসেছ, কার সাথে এসেছ, কিছুই জানতে চাইবো না! শুধু এইটুকু বলো, মালা কার গলায় দিলে! সেই ভাগ্যবান পুরুষটি কে!’

এতক্ষণ পর ফোঁস করে একটা স্বস্তির নি:শ্বাস ছাড়ল মহুয়া। চারিদিকে একবার নজর বুলিয়ে শাড়ির আঁচলটা টেনে গা-টা ঢেকে নিলো। ঠোঁটের কোণে শুকনো একটা হাসি ফুটিয়ে বলল,-‘হুমঁ:. দিতে আর পারলাম কই! এখনো তো মালাই গাঁথা হলো না আমার!’

বিস্মিত হলেও মৌ যে কুমারী, অবিবাহিতা, বুঝতে দেরী হলো না সুপ্রিয়র। খুশীও হলো মনে মনে! কিন্তু ওর চোখেমুখে তা প্রকাশ পেলনা। ইতিমধ্যে ঝুপঝুপ করে শুরু হয় বৃষ্টি। সুপ্রিয় বলল,-‘আরে, ভিজে যাচ্ছো যে! এসো এসো, আমার গাড়িতে এসো!’

মহুয়াকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ওর হাত ধরে টেনে গিয়ে ওকে বসিয়ে দিলো গাড়িতে। পকেট থেকে একটা হ্যান্ড রুমাল বের করে মহুয়ার হাতে দিয়ে বলল,-‘বৃষ্টিটা একটু ধরুক! ততক্ষণে কোনো একটা কফি শপে ঢোকা যাক। চলো, গলাটা একটু ভিজিয়ে আসি!’

বলে এক মুহূর্ত্যও আর দাঁড়াল না সুপ্রিয়। গাড়ি ষ্টার্ট করেই ডেনফোর্থ রোড ধরে দ্রত বেরিয়ে গেল।

মুহূর্ত্যরে জন্য আপসেট হয়ে পড়েছিল মহুয়া। কিছুদূর গিয়ে আমতা আমতা করে বলল,-‘না না, আজ নয়, আমাকে শীঘ্রই ফিরতে হবে। আপনি বরং মেইন সাবওয়েতে আমায় ড্রপ করে দিন।’

-‘সে কি! কাল তো শনিবার, তন্মধ্যে লং-উইকেন্ড! কোথাও বেড়াতে যাওয়া হবে বুঝি!’

মাথাটা নেড়ে মহুয়া জানাল, না।

-‘তা’হলে আর আপত্তি কিসের!’

-‘না, না, আজ আমায় শীঘ্রই বাড়ি পৌঁছাতে হবে! আপনি সাবওয়েতেই ড্রপ করে দিন! এতক্ষণে নিশ্চয়ই অপেক্ষা করছে বাপি!’

আপত্তি করল না সুপ্রিয়। কথা না বাড়িয়ে সাবওয়েতেই ড্রপ করে দিলো মহুয়াকে! কিন্তু যাত্রীর ভীঁড়ে মুহূর্ত্যে কোথায় যে অদৃশ্য হয়ে গেল ওর গাড়িটা, আর দেখতে পেলনা মহুয়া! তবু দু:খ ছিলনা, যদি অতীত জীবনের কিছু কথা সুপ্রিয় ওকে বলে যেতো। কিন্তু যে কথা ও’ সুপ্রিয়কে বলতে চেয়েছিল, তা তো বলাই হলো না! তা’হলে!

বাড়ি এসে কিছুতেই স্বস্তি পায়না মহুয়া। রাতেও ঘুম হয়না ওর! সারারাত এপাশ আর ওপাশ করে বিছানায়। আর ভাবে, ইস্, রাতটা পোহালেই দু:স্বপ্নের মতো কালো রঙে ছেয়ে যাবে মহুয়ার জীবন। কতগুলি অচেনা অপরিচিত লোকের সম্মুখে পুতুলের মতো কনে সেজে বসতে হবে। হুকুম করলেই হেঁটে চলে দেখাতে হবে, পাত্রীর সার্বিক গুনাবলীর নমুনা। অফার করলে, দু-একটা গান গেয়েও শোনাতে হবে! -উফ্:, অসহ্য!

রাগ হয় বিধাতার ওপর। বেশ ভালোই তো ছিল মহুয়া! রাতের দু:স্বপ্ন ভেবে সুপ্রিয়কে ভুলেই গিয়েছিল প্রায়! মুছে ফেলেছিল স্মৃতির পাতা থেকে। তবে কেন সেই দু:স্বপ্ন জলছবির মতো জীবন্ত হয়ে পূনরায় দেখা দিলো ওর জীবনে! কেন, কেন এমন হলো! -‘এ কেমন বিধাতার অগ্নিপরীক্ষা! হে ঈশ্বর, এতো নির্দয়, কঠোর তুমি হয়েও না! এতবড় শাস্তি আমায় দিওনা! শুধু একবার, সুপ্রিয়র খোঁজ আমায় এনে দাও ভগবান! আমায় কৃপা করো প্রভু!’

ভেবে কূল পায়না মহুয়া। ক্রমশ অস্খির হয়ে ওঠে! এতো বড় শহর, সুপ্রিয়কে কোথায় খুঁজবে, কোথায় পাবে! ও’ কোথায় থাকে, কার সাথে থাকে! ওর প্রফেশন কি, কিছুই তো বলে গেল না! ফোন নম্বরটাও তো দিয়ে গেলনা সুপ্রিয়! তবে কি এ জনমে ওর দর্শণ কোনদিনও আর পাবেনা মহুয়া!

ভাবতেই বুকটা ওর কেমন ছ্যাঁৎ করে উঠল। বিষন্নতায় ছেয়ে গেল মন-প্রাণ, সারাশরীর। ভালোবাসার সমস্ত ইচ্ছা-আবেগ-অনুভূতিগুলিও অনুশোচনা আর অনুতাপের আগুনে পুড়ে সব ছাই হয়ে গেল মহয়ার। মরে গেল বেঁচে থাকার সাধ। অগত্যা, হৃদয়ের দুকূল অশ্রুজলে প্লাবিত করে জীবন্ত লাশের মতো পড়ে থাকে, একেলা নির্জন অন্ধকার ঘরের কোণে।

( ৪ )

মাঘ মাস। কনকনে ঠান্ডা। হাঁড় কাঁপানো শীত। সকাল থেকে উদাস মনে চুপটি করে বসেছিল মহুয়া। অথচ সমানে দর দর করে ঘামছে সারাশরীর। সময় যতো বাড়ছে, বুকের ধুক্ধুকানিও ততো বাড়ছে। একসময় জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়ায়। মাথাটা ঠেকান দিয়ে শূন্যদৃষ্টিতে চেয়ে থাকে, দূর-নীলিমার প্রান্তরে উড়ে যাওয়া একঝাঁক মুক্ত বিহঙ্গের পানে। আর জলছবির মতো মনচোক্ষে ভেসে ওঠে, সুদীর্ঘ সাত বছর পর সেদিনের সেই ধূমকেতুর মতো অপ্রত্যাশিত হঠাৎ সুুুপ্রিয়র দর্শণ, আবির্ভাব। কথার আলাপন। দু’দিন আগে যা কল্পনাই করেনি।

হঠাৎ গাড়ির শব্দে চমকে উঠল মহুয়া! পর্দার আড়াল থেকে দেখলো, একঝাঁক যুবকের দল, একে একে সব নামছে গাড়ি থেকে। তন্মধ্যে একজন যুবকের চটকদারি পোষাক-আষাকে একটু ব্যতিক্রমই মনে হলো। সে একেবারে ফিল্মি হিরোর মতো পরনে জিন্সের প্যান্ট-শার্ট, চোখে সানগ্লাস, আর তার চমকপ্রদ হাইহিল শু-এর বাহারও চোখে তাক লাগার মতো। একেবারে ভি.আই.পি-র মতো বুকের ছাতি ফুলিয়ে নামল গাড়ি থেকে। অন্যদের চাইতে একটু স্প্যাশালই লাগছে তাকে। পাত্রই হবে নিশ্চয়ই! স্বগতোক্তি করে জানালার কাছ থেকে সড়ে এলো মহুয়া।

ইত্যবসরে পিতা অমলেন্দু রায়ের গলার আওয়াজ শুনে মহুয়া সড়ে এলো জানালা থেকে। তাদের স্বা:গতম জানাতে দ্রুত এগিয়ে আসেন তিনি। কিন্তু সদর দরজার গোঁড়ায় এসে থমকে দাঁড়ান। বিস্মিত হয়ে বললেন,-‘এ কি, সুপ্রিয় তুমি! তোমাকে তো চেনাই যাচ্ছে না! এদের সঙ্গে তুমি এলে কোথা থেকে!’

একগাল হেসে রবিন বলল,-‘স্যার, ওই তো আমাদের শ্রীমান মুখপাত্র! আপনার হবু জামাতা! সারপ্রাইজটা কেমন দিলাম বলুন তো!’

সবিস্ময়ে অমলেন্দু বললেন,-‘এ্যাঁ! বলো কি, আমাদের প্রিয়! আমি তো ভাবতেই পাচ্ছিনা। কি আশ্চর্য্য! এ তো আমার পরম সৌভাগ্য! কিন্তু কাজটা তুমি কি করলে বলো তো! কন্যার পিতা আমি, অথচ আমিই জানি না। অন্তত একবার ইনফর্ম করতে পারতে আমায়!’

হাসিটা মুহূর্তে মিলিয়ে গেল নবিনের। খানিকটা ইতস্তত বোধ করল। মাথাটা চুলকিয়ে আমতা আমতা করে বলল,-‘স্যার, প্রিয়দার সম্পর্কে আপনিই বেশী জানেন! আপনার বিশ্বস্খ এবং সজ্জন। শুধু তাই নয়, ভীষণ ভালো বাসেন, স্নেহ করেন আপনি। আর সেই হিন্টটা পেয়েই তো..!’ বলতে বলতে সানন্দে একগাল হেসে ফেলল রবিন। সগৌরবে দৃঢ় আশ্বাস দিয়ে বলল,-‘হিরের টুকরো স্যার! একেবারে হান্ডেড পার্সেন্ট পিওর! আই এ্যম শির্ও, টরন্টো শহরে কোথাও পাবেন না খুঁজে!’

ঈশ্বরকে স্মরণ করে অমলেন্দু বললেন,-‘সবই করুণাময়ীর ইচ্ছা! কপালে লেখা থাকলে, ঠেকাবার আমি কে! এসো, এসো, ভিতরে এসো, কথা হবে ক্ষণ!‘

অন্দর মহলের দিকে নজর বুলিয়ে বললেন,-‘কই গো, শুনছো, মা’মণিকে নিয়ে এসো শীগগির! ওরা এসে গিয়েছে সবাই।’

এদিকে হৃদয়পটভূমির অস্খিতিশীলতায় তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে মহুয়ার। হৃদস্পন্দন আরো দ্রুত গতীতে চলতে থাকে। অথচ তখনোও মনস্খির করতে পারেনা, কি করবে! একে একে আগুন্তুক অথিতিবৃন্দের কুশল বিনিময়, বাপ-ঠাকুরদার পরচিয়, মত বিনিময় সবই শেষ! এবার মহুয়ার পালা! মা রমলা দেবী দ্রুত এসে বললেন,-‘আয় খুকু, চল ওঠ! কিচেনরুমে চা-জল-খাবার ট্রে-তে সাজানো আছে। আয় আমার সঙ্গে, নিয়ে চল!’

অগত্যা ভারাক্রান্ত মুখে মায়ের পিছু পিছু বৈঠকখানায় পা রাখতেই বুকটা চমকে ওঠে মহুয়ার! থমকে দাঁড়ায়। চোখের তারাদু’টি ওর স্খির হয়ে যায়। -এ কি! ও’ সুপ্রিয় না!

খানিকটা বিস্ময়ের ঘোরে পড়ে যায় মহুয়া। চিনতে ভুল হচ্ছে না তো! বড় বড় চোখ পাকিয়ে তাকায়। মনে মনে বলল, হ্যাঁ, সুপ্রিয়ই তো, কিন্তু কি আশ্চর্য্য! ও’ এখানে এলো কি করে! হোয়াট এ সারপ্রাইজ্! আনথিঙ্কেবল! আনবিলিভয়েবল!’

চকিতে অব্যক্ত আনন্দে আর ভালোবাসার জোয়ারে হৃদয়ের দুকূল কানায় কানায় ভরে গেল। মেঘের আড়াল থেকে উদ্ভাসিত সূর্য্যরে উজ্জ্বল আলো মতো মুখখানা ওর মুহূর্তে দ্বীপ্তিময় হয়ে উঠল। তবুও বিশ্বাস হয়না নিজের চোখদু’টোকে! ভিতরে ভিতরে পুলকে বিকশিত হয়ে শিহরণে দোলা দিয়ে উঠল সারাশরীর।

একেই বলে বরাত! আবেগে অভিভূত মহুয়া স্তম্ভিত হয়ে যায় বিস্ময়ে! পলক পড়ে না। মনে মনে বলল,-‘ইউ আর রিয়েলি গ্রেট বাপি! ইউ আর নিয়েলি গ্রেট! যুগ যুগ জিও!

জল-খাবারের ট্রে-টা টি-টেবিলে রেখে দ্রুত চলে যাচ্ছিল। অমলেন্দু বললেন,-‘আরে যাচ্ছিস কোথায়, আয়, বোস এখানে! লজ্জা পাবার কি আছে! সুপ্রিয় আমার ছেলের মতো। আমরা একই ডিপার্টমেন্টে আছি। ও’ আমারই এ্যাসিসটেন্ট! বড় ভালো ছেলে! ওর মতো..!’

ইতিপূর্বে পাত্রীর মুখদর্শণে যেন আকাশ থেকে পড়ে সুপ্রিয়। আবেগে অভিভূতের মতো চেয়ে থাকে হাঁ করে! হতবাক হয়ে যায় বিস্ময়ে! জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছে না তো!

বিধাতারও কি লীলাখেলা, বোঝা ভার! এ তো স্বপ্নেরও অতীত! অবিশ্বাস্যকর ঘটনা!

অথচ হৃদয় সুমদ্রে কি যে উথাল-পাথাল হয়ে যাচ্ছে দুজনের, তা বুঝতেই দিলো না। আগুন্তুক অথিতিরাও কিছুই টের পেলোনা কেউ। কিন্তু এসব ঘটলো কেমন করে! আর সম্ভবই বা হলো কেমন করে! ভেবে কূল পায়না মহুয়া। চোখমুখ, সারাশরীর ঘেমে অস্খির। হয়রান হয়ে যায়। আর ওর ঐ ব্যতিক্রম চেহারা লক্ষ্য করে নিরবতা ভঙ্গ করলেন অমলেন্দু। কিঞ্চিৎ উৎকন্ঠিত হয়ে বললেন,-‘হোয়াট হ্যাপেন্ড মামণি? আর উই ওকে?’

সলজ্জে দুইহাতে মুখ লুকায় মহুয়া। মাকে জড়িয়ে ধরে। হঠাৎ অপ্রত্যাশিত আনন্দ ও আবেগের সংমিশ্রণে অশ্রুকণায় চিক্চিক্ করে উঠল ওর চোখদু’টো! সাশ্রু নয়নে সুপ্রিয়র!চোখে চোখ রেখে বলল,-‘আই এ্যাম ও.কে বাপী, আই এ্যাম ও.কে! ভেরী হ্যাপী! আই এ্যাম সো হ্যাপী নাউ!’

সমাপ্ত

যুথিকা বড়ুয়া : কানাডার টরন্টো প্রবাসী গল্পকার ও সঙ্গীত শিল্পী।