খেজুর রসের পিঠা-পায়েস খাওয়া হলো না ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের

খোকন আহম্মেদ হীরা, রহিমগঞ্জ থেকে ফিরেঃ “মা ছুটি পেলে আগামি বছর শীতের মৌসুমে দেশে এসে খেজুর রসের পিঠা ও পায়েস খাবো। তুমি আমাকে একটু Captain Mohiuddinদোয়া করে দাও”। এ সময় দাদার দু’চোখ দিয়ে শুধু পানি ঝড়ে পরছিলো। কথাগুলো বলছিলেন, বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর-এর ছোট ভাই মঞ্জুর রহমান বাচ্চু (৫৫)।

তিনি আরো বলেন, দেশ থেকে সবশেষ ১৯৬৯ সনের ২৮ অক্টোবর দাদা (মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর) কর্মস্থল পশ্চিম পাকিস্তানের ১৭৩ নম্বর ইঞ্জিনিয়ার ব্যাটালিয়নের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। সে সময় আমি ও আমার মা সাফিয়া খাতুন নানাবাড়ি বরিশালের মুলাদীর নন্দিরবাজার ষ্টীমার ঘাট থেকে দাদাকে ষ্টিমারে তুলে দিতে গিয়েছিলাম। সেময় আমি নবম শ্রেনীর ছাত্র। দাদা মাকে বলেছিলো শীতের মৌসুমে দেশে এসে পিঠা-পায়েস খাওয়ার কথা। দাদা আমাকে বলেছিলো ভালো করে লেখাপড়া করিস। এটাই ছিলো দাদার সাথে আমার ও মায়ের শেষ দেখা। পরবর্তীতে ছুটি না পাওয়ায় দাদা আর দেশে আসেননি। তবে তৎকালীন করাচীর শেফা রোডের বড় বোনের বাসায় মাঝে মধ্যে এসে দাদা দেখা করতো। এরপর দেশে যুদ্ধ শুরু হয়। ১৯৭১ সনের ৩ জুলাই পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বন্দিত্বের নাগপাশ ছিন্নকরে এসে দাদা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করেন। তিনি (ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর) রাজশাহী জেলার চাঁপাইনবাগঞ্জের সীমান্ত এলাকার ৭ নং সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন। ১৪ ডিসেম্বর ভোরে দাদা ও তার সহযোদ্ধারা চাঁপাইনবাবগঞ্জের রেহাইচরের মধ্য দিয়ে নৌকাযোগে মহানন্দা নদী পাড় হয়ে অর্তকিত ভাবে আক্রমন চালিয়ে পাকসেনাদের কয়েকটি ট্রেঞ্চ দখল করে নিয়েছিলেন। এসময় উভয়পক্ষের মধ্যে মুখোমুখী যুদ্ধে পাক সেনাদের ছোঁরা একটি বুলেট (গুলি) দাদার কপালে আঘাত করে। এর কিছুক্ষনের মধ্যেই দাদা (ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর) শাহাদাতবরন করেন। ১৫ ডিসেম্বর দাদাকে ঐতিহাসিক সোনামসজিদ প্রাঙ্গনে সমাহিত করা হয়। দাদা শহীদ হওয়ার প্রায় একমাস পর ১০ জানুয়ারি আমরা দাদার মৃত্যুর খবর পাই। বাবা-মা এমনকি আমাদের পরিবারের কেউই শেষবারের মতো দাদার লাশ দেখতে পারিনি। পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধে বীরোচিত ভূমিকা ও আত্মত্যাগের স্বীকৃতি স্বরূপ দাদাকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবে ভূষিত করা হয়।

সেইদিনের কথা বর্ননা করতে গিয়ে বার বার কান্নায় ভেঙ্গে পরেন একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম লড়াকু সৈনিক শহীদ ক্যাপ্টেন বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর (ইঞ্জিঃ)-এর বড় বোন রাহানু বেগম আলো (৭১)। কান্নাজড়িত কন্ঠে তিনি বলেন, ও আমাকে বলেছিলো-“আপা তুমি আমাকে নিষেধ করো না। আমি যুদ্ধে যাবোই। আর যুদ্ধ জয়ের বিজয় পতাকা নিয়েই বীরের বেশে স্বাধীনদেশে বাবা-মাকে দেখতে যাবো। কতো মা তার পুত্রকে হারাচ্ছে, কতো বোনইতো তার ভাইকে হারাচ্ছে। তাদের কথা একটু চিন্তা করো। সেখানে আমাকে নিয়ে তোমরা এতো ভাবছো কেন। তোমরা সবাই আমার জন্য দোয়া করো, আমি দেশটাকে স্বাধীন করে বিজয় পতাকা উড়াবোই”। কথাগুলো বলার সময় ওর দু’চোখ দিয়ে শুধু পানি ঝড়ছিলো। আর এটাই ছিলো করাচীর বাসায় বসে আমার সাথে ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের শেষ কথা ও শেষ দেখা।

বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার প্রত্যন্ত আগরপুর ইউনিয়নের রহিমগঞ্জ গ্রামের সম্ভ্র্যান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯৪৯ সনের ৭ মার্চ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর জন্মগ্রহন করেন। তার পিতা বিশিষ্ট সমাজসেবক মৌলভী আব্দুল মোতালেব হাওলাদার, মাতা সাফিয়া খাতুন। ৩ ভাই ও ৫ বোনের মধ্যে তিনি (মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর) ছিলেন দ্বিতীয়। ১৯৬৭ সনে পাকিস্তানী মিলিটারী একাডেমীতে (কাকুলে) তিনি জেন্টলম্যান ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন।

এ বীর সৈনিকের জন্মভূমি বাবুগঞ্জ উপজেলার রহিমগঞ্জ গ্রামে ২০০৮ সনে স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রনালয়ের অর্থায়নে সর্বমোট এককোটি পনের লক্ষ টাকা ব্যয়ে “বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর” নির্মান করা হয়। ওই বছরের ২১ মে গ্রন্থাগার ও জাদুঘরের উদ্বোধন করা হয়। ওইসময় আগরপুর ইউনিয়নকে “বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর নগর ইউনিয়ন” হিসেবে ঘোষনা করা হয়েছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, নির্মানকাল থেকে গ্রন্থাগারে বেশ কিছু বই থাকলেও জাদুঘর হিসেবে এখানে কিছুই নেই। গ্রন্থাগার ও জাদুঘরে যাতায়াতের রাস্তাটির অবস্থা খুবই নাজুক।

গ্রন্থাগারের লাইব্রেরিয়ান হারুন-অর রশিদসহ স্থানীয় একাধিক ব্যক্তিরা আক্ষেপ করে বলেন, বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরে আসার জন্য রাস্তার অবস্থা নাজুক থাকায় দশনার্থীদের যাতায়াত করতে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। তারা জরুরি ভিত্তিতে জাদুঘর থেকে জয়শ্রী বাসষ্ট্যান্ড পর্যন্ত ৮ কিলোমিটার সড়কের কাঁচা দু’কিলোমিটার সড়ক পাকা করন, বীরশ্রেষ্ঠ’র জাদুঘরের প্রবেশদ্বার বরিশাল-ঢাকা মহাসড়কের জয়শ্রী বাসষ্ট্যান্ড এলাকায় সরকারি উদ্যোগে একটি তোরন নির্মান, জাদুঘরে মুক্তিযুদ্ধের ছবি সংবলিত ও স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতি চিহ্নের কিছু সরঞ্জামাদি সরবরাহের জন্য প্রধানমন্ত্রী ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে জোর দাবি জানিয়েছেন।