সংসদ চত্বরে জুয়ার আসর, অফিসার্স ক্লাবে ভারতীয় জংলি ডিসকো

এক. ভারতের নির্বাচনী ইতিহাসের সবচেয়ে আলোচিত, আলোড়িত ও বিতর্কিত প্রধান নির্বাচন কমিশনার ছিলেন টিএন শেষণ। মইন উ আর ফখরুদ্দীনের অবৈধ সম্পর্কের ফসল আমাদের প্রধান নির্বাচন কমিশনার ড. শামসুল হুদার মতো তিনি বাঁচাল ছিলেন না। কথা একটা ঠাস করে বলে, ঠেলার সামনে বায়ুত্যাগ করে, আবার আশি ডিগ্রি ঘুরে নিজের থুথু নিজে চাটার মতো ফালতু ছিলেন না শেষণ। শক্ত ধাতের মানুষ ছিলেন তিনি। ছিলেন অত্যন্ত বিচক্ষণ, দক্ষ ও সাহসী প্রশাসক। যে কারণে ইন্দিরা গান্ধী থেকে আদভানি পর্যন্ত সবাই তাকে সমীহ করতেন। কারণ তিনি ভাঙতেন কিন্তু হুদা ছহুল সাখাওয়াতের মতো দিনে দশবার মচকাতেন না। তাছাড়া তার দৃঢ়চেতা ব্যক্তিত্বের কারণে কেউ তাঁকে ঘাটাতো না। শেষণ হারভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছিলেন। ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস (আইপিএস এবং আইএএস) পরীক্ষায় সারা ভারতে প্রথম হয়েছিলেন। শেষণ নিজেকে নিয়ে রহস্য করে বলতেন, আমি হলাম ‘অ্যালশেষণ’।

সেই শেষণ প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে অবসর নেয়ার পর ‘ভারতের অধঃপতন’ নামে বই লিখে সারা ভারতে তোলপাড় তুলেছিলেন। এই বইয়ের ভূমিকায় তিনি লেখেন : ‘বহু বিচিত্র রজনী আমি যাপন করেছি দেশের চারিত্রিক অধঃপতনের কথা ভেবে, আর এই ভেবে, যাতে আমাদের চরিত্রশক্তি আবার পুনরুজ্জীবিত হয়, তার জন্য আমি কী করতে পারি। আমার দুশ্চিন্তা দুর্ভাবনা অনেক কিছু নিয়ে, বহু বিষয়ে পরিব্যাপ্ত। তাই মনে হলো, আমার ভাবনা-চিন্তাগুলো স্পষ্ট করে তুলতে, সবচেয়ে ভালো হয় যদি আমি কাগজে-কলমে সেগুলো লিখে ফেলি। আসলে এটাই হলো এই বইখানির জন্মের ইতিহাস।’
শেষণ তার বইয়ে বলেছেন, ‘আবহমান কাল থেকে ভারতবর্ষের সত্তার একটি উপাদান এক শক্তিশালী নৈতিক চেতনা এবং আচরণবিধি এবং এই সেদিন পর্যন্ত অন্যদের তুলনায় বলা যায়, দেশের যারা শাসনকর্তা তাদের মধ্যেও যে নৈতিক ভ্রষ্টাচার দেখা দিতে পারে, এমন সম্ভাবনাকে ভারতবাসী আমলই দিত না।

ভারতীয়দের দৃষ্টিতে একজন আদর্শ নৃপতি তিনি যিনি নৈতিকতার বিচারেও সবার উপরে, যিনি ধর্মের পথ থেকে বিচ্যুত হন না কখনও।’

তারপর শেষণ বর্তমান ভারতীয় রাষ্ট্রের দুই প্রধান স্তম্ভ আইন বিভাগ ও প্রশাসনের অধঃপতনের চিত্র আঁকতে গিয়ে লেখেন, ‘সে ব্যক্তি রাজ্যসভার সদস্য। পুলিশ তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল অপহরণের এবং ১৬ বছরের একটি বালিকার ওপর বলাত্কারের অভিযোগে। খবরটি যে খবরের কাগজের হেডলাইনে ফলাও করে ছাপা হয়েছিল, সেটা এই কারণে নয় যে, একজন রাজনীতিক তাতে জড়িত ছিলেন। কারণটা ছিল এই যে, সেই সাহসিনী নারী দ্বিতীয়বার এমএলএ মহোদয় তাঁর ওপর অত্যাচার করতে গেলে, তার পুরুষাঙ্গটি ছেদন করেছিলেন। একে কী বলা যায়, মানবজাতির (কিংবা গণতন্ত্রের) অনুকূলে একটি ছোট্ট পদক্ষেপ?’

তারপর বলেছেন, এ তো ছিল সেই দেশ, যে দেশে নেহেরুর সময় কে ডি মালব্য ছিলেন খনিমন্ত্রী। কোনো এক নির্বাচনের সময় মালব্য একজন শিল্পপতির কাছে ১০ হাজার টাকা চেয়েছিলেন একজন দলীয় প্রার্থীর জন্য। নিজের জন্য নয়। কয়েকদিন পরে নেহেরু তাকে ডেকে পাঠিয়ে সেই চিঠিটা দেখালেন। মালব্য বললেন, এটাা আমারই লেখা চিঠি। নেহেরু বললেন, তাহলে আমাকে আপনার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করতে হবে। এক ঘণ্টার মধ্যে মালব্য নেহেরুর কাছে তার পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিলেন।

রাজনৈতিক নেতাদের চরিত্র চিত্রণের পাশাপাশি আমলাতন্ত্রেরও নাড়িভুঁড়ি বের করে দিয়েছেন শেষণ : ‘এখন হবু শ্বশুরবাড়ির লোকেরা সরাসরি চলে আসেন মুসৌরিতে, যেখানে আইএএস প্রবেশনারদের ট্রেনিং হয় এবং কে কত বেশি পণ দিয়ে কত ভালো পাত্রটি ‘কিনতে’ পারেন তা নিয়ে তাদের মধ্যে রেষারেষি চলে এবং এসব তরুণ, যারা নাকি দেশের শাসন পরিচালনা শিখছেন, হবু শ্বশুরদের পণের প্রস্তাব অম্লানবদনে স্বীকার করে নেন, যদিও তারা জানেন তাদের সে কাজ আইনের চোখে গর্হিত, নৈতিকতার বিচারে জঘন্য।’

শ্বশুরের পণের টাকায় বেড়ে ওঠা ভারতের আজকের সিভিল সার্ভিসের অফিসার, যদিও বেতন আহামরি কিছু নয়, বিলাসবহুল বাড়িতে থাকেন, যে বাড়ির আসবাবপত্র এবং অন্যসব সাজ-সরঞ্জামের দাম কয়েক কোটি টাকা। তার ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করে লন্ডনে, ঠিকাদারদের খরচে।

ভারতের এই অবস্থাকে শেষণ বলেছেন, ভারতের অধঃপতন। এ নিয়ে ভেবে তিনি বহু রাত নির্ঘুম কাটিয়েছেন। ভারতের সঙ্গে তুলনায় আজকের বাংলাদেশের অবস্থা কী? এটাকে কি অধঃপতন বলবেন? নাকি তার চেয়েও ভয়ঙ্কর দুর্বিষহ কোনো অবস্থায় আমরা পতিত হয়েছি?

দুই. মাছের নাকি পচন ধরে মাথা থেকে। শেষ পর্যন্ত আমাদেরও তাই হলো নাকি? খবরটা পড়ে গালে হাত দিয়ে বসে আছি। জাতীয় সংসদের পবিত্র অঙ্গনে বসছে জুয়ার আড্ডা। অফিসার্স ক্লাবে জমে উঠেছে অশ্লীল ডিস্কো।

এমন অভিযোগও পাওয়া যাচ্ছে, সংসদ ভবন এলাকায় প্রতিষ্ঠিত এই ক্লাবে কেউ কেউ গ্রুপ বেঁধে রীতিমত জুয়ার আসর বসাচ্ছেন। সেখানে পার্লামেন্ট মেম্বার ছাড়াও বহিরাগতরা নিয়মিত অংশ নিচ্ছেন। স্পিকার আবদুল হামিদ এ ব্যাপারে সতর্ক করলেও সংশ্লিষ্টরা তা আমলে নেয়ার গরজ বোধ করছেন না।

সংসদ সদস্য ক্লাবে নিয়মিত বিলিয়ার্ড ও টেনিস খেলা হয়। কেউ কেউ তাস খেলেন। কেউ টুয়েন্টি নাইন, কলব্রিজ খেললেও অনেক সদস্য টাকার বাজি ধরে জুয়াও খেলছেন। যা অনেক সময় গভীর রাত অবধি চলে। কয়েকজন সংসদ সদস্যের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও ক্লাবে নিয়মিত আড্ডা দেন।

অভিযোগ সম্পর্কে সরকার দলের চিফ হুইপ আবদুস শহীদ গলা চড়িয়ে বলেছেন, ঢাকা ক্লাবসহ কোন ক্লাবে তাস খেলা হয় না? ঢাকা ক্লাব বা অন্যান্য ক্লাবের মতো এখানে তো মদ খাওয়া হয় না।
সরকার দলের আরেকজন এমপি আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী আরও এক ধাপ গলা চড়িয়ে বলেছেন, ক্লাব তো বিনোদনের জন্যই। এখানে কেউ রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে আসে না। কেউ কেউ টাকা দিয়ে মজা করে তাস খেললেও সে রকম পেশাদার জুয়াড়ি কেউ নেই। বেশিরভাগই কলব্রিজ খেলেন। আমি নিজেও দু’একদিন খেলেছি।

এই দুই রাজনীতিবিদের কথায় প্রতিবাদ আছে। কিন্তু স্বীকৃতিও আছে অভিযোগের। অর্থাত্ ঢাকা ক্লাবে তাস খেললে, মদ খেলে দোষ হয় না। দোষ আমাদের!

আরেকজনের ‘টাকা দিয়ে মজা করে তাস খেলে’—কথার পরের বাক্যটি হলো, তবে পেশাদার জুয়াড়ি কেউ নেই। অর্থাত্ যারা আছে তারা অপেশাদার জুয়াড়ি। টাকা দিয়ে তাস খেলাকে জুয়া বলা হলেও তারা এটা খেলেন মজা করার জন্য। সে জন্য ওর মধ্যে দোষের কিছু নাই! কি অদ্ভুত যুক্তি। চুরির চুরি তারপর আবার সিনাজুরি!

তিন. রাজনীতির শীর্ষ পীঠস্থান মহান জাতীয় সংসদ সদস্যদের কিঞ্চিত্ নতিজা পেশের পর এবার চলুন যাওয়া যাক রাষ্ট্রের আরেক স্তম্ভ বেইলি রোডের অফিসার্স ক্লাবের দিকে। আসন্ন থার্টিফার্স্ট নাইটে অশ্লীল অনুষ্ঠান আয়োজন করার অভিযোগ উঠছে এই ক্লাব কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। থার্টিফার্স্ট নাইটে অফিসার্স ক্লাবে ভারতীয় শিল্পীদের নিয়ে এসে ডিস্কোর আয়োজন করা হয়েছে। এরই মধ্যে সদস্যদের মধ্যে আমন্ত্রণপত্র পাঠানো হয়েছে। কার্ডের ভাষা ও আমন্ত্রিত শিল্পীদের নাম দেখে হতবাক হয়ে গেছেন সাধারণ সদস্যরা। একাধিক সদস্য জানিয়েছেন, সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য আলো-অন্ধকারের মিশেলে ভারতীয় নর্তকীদের এনে জংলি নাচের আয়োজন করা রুচিহীন ও নষ্ট মানসিকতার পরিচায়ক। এরই মধ্যে এই ঘটনায় সাধারণ সদস্যদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ও ক্ষোভের জন্ম হয়েছে।

বিজয়ের এ মাসে ক্লাবে নতুন বছরকে বরণ করার দোহাই দিয়ে অফিসার্স ক্লাবে যে অশ্লীল ডিস্কোর আয়োজন করা হচ্ছে তাতে অংশ নেবে ভারতীয় ডিস্কোজকি হার্দিক। এ অনুষ্ঠানের জন্য যে আমন্ত্রণপত্র পাঠানো হয়েছে তাও রুচিহীনতার পরিচয় বহন করে। পরিবারের কোমলমতী শিশুদের নিয়ে এ ধরনের অনুষ্ঠানে যোগ দেয়া বেশিরভাগ সদস্যের পক্ষেই সম্ভব হবে না। অতীতে অনেক সুনামের অধিকারী ছিল ক্লাবটি। দেখা যাচ্ছে বর্তমানে এটি অশ্লীল আড্ডার স্থানে পরিণত হয়েছে। পদাধিকার বলে ক্লাবের সভাপতি মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররফ হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভা থেকেই এহেন কাণ্ডজ্ঞানহীন কর্ম সম্পাদিত হয়েছে।

চার. নিজের দেশের সরকার সম্পর্কে রাজনৈতিক ভাষ্যকার ও হাস্যরসিক পি জে ও’রুরাক তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘পার্লামেন্ট অব হোরস’ (১৯৯২)-এ লিখেছেন, ‘মানুষ এমন বড় জিনিস কিছু চায় না, চায় শুধু সুশৃঙ্খল নাগরিক জীবন। এই ইচ্ছার মধ্য থেকে কেমন করে বেরিয়ে এল এক দানবাকৃতি জীব যার প্রতি রন্ধ্র থেকে নিঃসৃত হচ্ছে লালা, বেরিয়ে এল এক অতিকায় দুষ্টু ব্রণ, ক্ষমতায়, অপরিমিত অর্থব্যয়ের এক দৈত্য? যারা নাকি এক স্বাধীন জাতি, তারা কী করে জন্ম দিল এক হিংস্র অতিকায় অক্টোপাস জাতীয় জীবের, যার আধিপত্যের বাহু আমাদের রাজনৈতিক জীবনের প্রতি ছিদ্রপথ দিয়ে আজ প্রবেশ করছে? তারপর এই সরকার, অর্থবলে স্ফীত, হস্তক্ষেপ করে চলেছে আমাদের সব ব্যাপারে—আমাদের জীবনের প্রত্যেকটি ক্ষুদ্রতম ক্ষেত্রে বিপজ্জনকভাবে অনধিকার প্রবেশ করেছে এই বিপুলাকার, নির্বোধ, লোভী সরকার।’

তার মতো করে আমরা যদি বলতে পারতাম, স্বাধীনতা লাভের ৪০ বছর পর কোত্থেকে এলো এই আপদ, এই রাজনীতিবিদ, সংসদ সদস্য, উচ্চপদস্থ অফিসার, যারা সংসদভবন চত্বরে জুয়া খেলে, অশ্লীল জংলি নৃত্য দেখার জন্য বিলি করে আমন্ত্রণ পত্র? স্বাধীনতার ৪০ বছর পর যে দেশের ৮০ ভাগ লোক দু’বেলা দু’মুঠো খেতে পায় না, যে দেশের মানুষ জীবনের জন্য, বাঁচার জন্য মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, আমেরিকায় রাস্তাঘাট ঝাড়ু দিয়ে যায় সর্বস্ব পণ করে, একটি স্বাধীন দেশের মেয়েরা বিক্রি হয়ে যায় পতিতালয়ে, কাজের ঝি হতে ছুটে যায় দেশে দেশে, যে দেশে শিশুরা খাদ্যের অভাবে আত্মহত্যা করে, সেই দেশের ভেতর কোন পাপে জন্ম নিয়েছে এসব স্বার্থপর অজগর?

তাহলে কি আমাদের মুক্তিযুদ্ধে, আমাদের দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামে কোথাও কি ভুল ছিল, গলদ ছিল—যে কারণে সেই ছিদ্র পথে আমাদের সোনার সংসারে ঢুকে পড়েছে কালসাপ? সেই ভুলের জন্যই কি আবেগের দোকানদার লাজলজ্জাহীন ফ্যাসিস্টরা কব্জা করেছে ক্ষমতার মসনদ? আর নির্বিকারে খেয়ে নিচ্ছে, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব?

Source : Internet