আলু চাষে দারুন উৎসাহী হয়ে উঠেছেন। আর সে কারনে গত এক সপ্তাহ থেকে কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছেন বরিশালের গৌরনদী, আগৈলঝাড়া ও উজিরপুর উপজেলার আলু চাষীরা। চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় আনুপাতিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে বিভিন্ন জাতের বীজ আলুর মূল্য। আবহাওয়া অনূকুলে থাকলে এখনকার রোপিত আলু আগামি ৭০ থেকে ৭৫ দিনের মধ্যে ঘরে তোলা সম্ভভ বলে জানিয়েছেন চাষীরা। তবে এসব উপজেলার আলু চাষীরা এখনই তাদের উৎপাদিত আলু হিমাগারে রাখা (সংরক্ষিত) নিয়ে শংকিত হয়ে পরেছেন। তার পরেও এসব উপজেলার প্রায় সহস্রাধীক আলু চাষী গত বছরের লোকসানের কথা ভুলে এখন লাভের আশায় আলু রোপনে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। আলু চাষের প্রধান উপকরন সারের মূল্য কমে যাওয়া অর্থাৎ উৎপাদন খরচ কমে যাওয়ায় স্বাভাাবিকভাবেই আলু চাষে কৃষকদের উৎসাহ বেড়ে গেছে। স্থানীয় কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, চলতি আলু চাষ মৌসুমে জেলার গৌরনদী, আগৈলঝাড়া ও উজিরপুর উপজেলায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি অর্থাৎ রেকর্ড পরিমান জমি আলু চাষের আওতায় আসবে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারন অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে গৌরনদী, আগৈলঝাড়া ও উজিরপুর উপজেলার প্রায় ৩ হাজার ৫’শ হেক্টর জমিতে আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করা হয়েছে। তবে চলতি আলু মৌসুমে এ লক্ষ্যমাত্রা দ্বিগুন হতে পারে। গত মৌসুমে এসব উপজেলায় আলুর উৎপাদন চাহিদার চেয়ে দ্বিগুন হলেও কাঙ্খিত মূল্য ও এসব এলাকায় হিমাগার না থাকায় আলু চাষ নিয়ে কৃষকরা শংকিত হয়ে পরেছিলেন। কিন্তু আলু মৌসুমের শুরুতেই সরকার সারের মূল্য কমিয়ে দেয়ায় আলু চাষে কৃষকরা আবারো আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। এ কারনেই স্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে আলুর বীজের চাহিদা। ফলে ৬’শ টাকার আলু বীজের প্রতি বস্তার মূল্য হঠাৎ করে বেড়ে এক থেকে দেড় হাজার টাকায়।
উজিরপুরের কারফা বাজারের বীজ আলুর ডিলার অরুন হালদার বলেন, গত বছর এসব উপজেলায় ডায়মন্ড জাতের আলু বীজের চাহিদা থাকলেও এবছর উন্নতমানের হীরা মার্কা বীজ আলু বিক্রি হচ্ছে বেশি। তিনি আরো বলেন, বর্তমানে বীজ আলু ৫০ কেজির বাক্স ভর্তি বিক্রি হচ্ছে ৭ থেকে ৯ হাজার টাকায়। আর হীরা মার্কা ৪০ কেজির প্রতিবস্তা বিক্রি হচ্ছে ১৪’শ ৮০ টাকায়।
সরেজমিনে দেখা গেছে, গত বছরের তুলনায় উৎপাদন খরচ বিঘা প্রতি প্রায় ৫ হাজার টাকা কমে যাওয়ায় কৃষকরা এখন উৎসবমুখর পরিবেশে আলু চাষ শুরু করেছেন। আর আলু চাষীদের এখন দিনরাত সমানতালে সহযোগীতা করছেন পরিবারের নারী ও শিশুরা। মাদ্রা গ্রামের লাবনী রানী ষষ্ট শ্রেনী, সুর্বনা হালদার ও রানী হালদার সপ্তম শ্রেনীর ছাত্রী। স্কুলে যাওয়ার পূর্বে ও ছুটির পর বাড়িতে ফিরে তারা বাবা-মায়ের সাথে একত্রে মিলেমিশে আলু রোপনের জন্য জমিতে কাজ করছে। আলু চাষীদের মতে, আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে চলতি মৌসুমে এসব উপজেলায় রেকর্ড পরিমান আলু উৎপাদন হবে।
বরিশালের সর্বাধিক আলু উৎপাদনকারী এলাকা বলেখ্যাত আগৈলঝাড়া উপজেলার রতœপুর, আস্কর, মোল্লাপাড়া, সাহেবেরহাট, গৌরনদীর চাঁদশী ও উজিরপুর উপজেলায় কারফা ও মাদ্রা এলাকার প্রায় ২০টি মাঠের কৃষকদের সাথে আলাপকালে জানা গেছে, গত এক সপ্তাহ থেকে আলু চাষের জন্য জমি প্রস্তুতের কাজ শুরু হয়েছে। আলু চাষী ভাগ্য দাস হালদার (৪৫), কালু হালদার (৫০), পঙ্কজ হালদার (৪০)সহ অনেকেই জানান, গত বছর যেখানে ৫০ কেজির প্রতি বস্তা মিউরেট অব পটাশ (এমওপি) সার বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ৭’শ ৫০ টাকায়। এ বছর তা বিক্রি হচ্ছে শুধু মাত্র ৭৫০ টাকায়। ডিএপি ও ট্রিপল সুপার ফসফেটের (টিএসপি) প্রতি বস্তার দাম গত বছর ছিলো ২ হাজার টাকা। এবার তা বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৩৫০ টাকায়। এছাড়াও গত বছর ধানের মন ৪’শ থেকে ৫’শ টাকা হলেও এ বছর তা বিক্রি হচ্ছে ৮’শ থেকে ৮’শ১০ টাকা মন দরে। ফলে সারের দাম কমে যাওয়ার পাশাপাশি ধানের দাম বেশি পেয়ে কৃষকেরা এবার ব্যাপক উৎসাহে আলু চাষ শুরু করেছেন। গত বছর যেখানে বিঘা প্রতি উৎপাদন খরচ হয়েছে ১৫ থেকে ১৭ হাজার টাকা। এ বছর সেখানে খরচ পড়ছে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। এতে বিঘা প্রতি ৬০ মন হারে আলু উৎপাদন হলেও লোকসান গুনতে হবে না এমন নিশ্চয়তায় কৃষকরা প্রতিযোগিতা করে আলু চাষে মনোযোগী হয়েছেন।
স্থানীয় সার ডিলারদের সাথে আলাপকালে জানা গেছে, সারের মূল্য কমে যাওয়ার পর থেকে এলাকায় ভারতীয় নিন্মমানের সার আসা বন্ধ হয়ে গেছে। কারফা গ্রামের আদর্শ কৃষক সুখ লাল হালদার (৪৫) জানান, গত বছর তিনি ১৫ বিঘা জমিতে আলু চাষ করেছিলেন। বাম্পার ফলনও হয়েছিলো। তবে স্থানীয় পর্যায়ে হিমাগার না থাকায় তিনি আলু সংরক্ষণ করতে পারেননি। ফলে তড়িঘরি করে লোকসানে তা বিক্রি করে দিতে হয়েছে। এবছর তিনি লাভের আশায় ২০ বিঘা জমি আলু চাষের জন্য প্রস্তুত করার কাজ শুরু করেছেন। আগৈলঝাড়ার চাষী প্রবীর বিশ্বাস জানান, গত বছর তিনি মাত্র ৪০ শতক জমিতে আলু চাষ করেছিলেন। এবার সারের দাম কম থাকায় তিনি নিশ্চিত লাভ হবে জেনে ১২ বিঘা জমিতে আলু চাষ শুরু করেছেন। একইভাবে অসংখ্য আলু চাষীরা জানান, গতবারের চেয়ে তারা প্রায় দ্বিগুন পরিমান জমিতে আলু চাষের কার্যক্রম শুরু করেছেন।
গৌরনদীর চাঁদশী গ্রামের আলু চাষী নজরুল ইসলাম জানান, উৎপাদিত আলু সংরক্ষনের জন্য গৌরনদী, আগৈলঝাড়া ও উজিরপুরে কোন হিমাগার না থাকায় প্রতিবছর আলু চাষীরা নায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তিনি আরো জানান, গত বছর তিনি ৫৪ শতক জমিতে আলু চাষ করেছিলেন। এতে তার খরচ হয়েছে ২২ হাজার টাকা। আলুর ফলন হয়েছে ৫টন। যার বাজার মূল্য প্রায় ৫০ হাজার টাকা। তার উৎপাদিত আলু হিমাগারে সংরক্ষন করতে না পারায় কমমূল্যেই স্থানীয় পাইকারদের কাছে তিনি আলু বিক্রি করে দিয়েছেন। একইভাবে আলু সংরক্ষন করতে না পারায় প্রতি বছরই বাধ্য হয়ে চাষীরা কমমূল্যে পাইকারদের কাছে আলু বিক্রি করে দিচ্ছেন। চাষীরা জানান, এতদাঞ্চলের মধ্যে মাদারীপুর, ফরিদপুর ও বরিশালে হিমাগার রয়েছে। সেখানে আলু রাখাকে কেন্দ্র করে প্রতি বছরই হিমাগারের সংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের সাথে হাতাহাতির মতো ঘটনাও ঘটছে। তারা সরকারি ভারে স্থানীয়ভাবে হিমাগার নির্মানের জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।