একজন কলম যোদ্ধার করুন পরিনতি

তিনি কিনা আজ মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে যাচ্ছেন। নির্ভিক ও সাহসী এ কলমযোদ্ধা সংবাদের খোঁজে দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলতেন বরিশালের উত্তর জনপদের মেঠোপথে। যিনি সংবাদ সংগ্রহের পর সংবাদ লিখতেন তিনিই আজ সংবাদ হয়ে গেছেন। বরিশালের উত্তর জনপদের মাটি ও মানুষের সাথে যার ছিলো গভীর মায়া মমতা ও ভালবাসা, ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস আজ ১০দিন ধরে তিনি সবকিছু ফেলে ঢাকার শমরিতা হাসপাতালের বেডে ছটফট করে দিনাতিপাত করছেন। মৃত্যুর পথযাত্রী এ কলম যোদ্ধাকে একনজর দেখতে শমরিতা হাসপাতালে ছুঁটে গেছেন অসংখ্য রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের ব্যক্তিরা। চিকিৎসার্থে সবাই সহযোগীতার আশ্বাসও দিয়েছেন। কিন্তু এক মহানুভব ব্যক্তির আর্থিক সহযোগীতা ছাড়া আর কেউই এগিয়ে আসেননি। দেশের স্বনামধন্য ও সবার পরিচিতি একটি ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠানের সদ্য প্রকাশিত একটি দৈনিকের কর্তৃপক্ষ পর্যন্ত তার পত্রিকার প্রতিনিধির চিকিৎসার খোঁজ খবর নেয়নি। এমনকি হাসপাতালে পর্যন্ত দেখতে যাননি তাদের প্রতিনিধিকে। অথচ ওই পত্রিকার জন্য সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়েই মর্মান্তিক সড়ক দূর্ঘটনার স্বীকার হন এ কলম যোদ্ধা। আর সেই প্রতিষ্ঠানেরই যদি হয় এ অবস্থা এরচেয়ে হতভাগ্য কলমযোদ্ধা আর হতে পারে না। নিজ প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধির যেখানে খোঁজ নিতে পারছেন না সেখানে ওই প্রতিষ্ঠান কি করে জনগনের খোঁজ নিবেন। এ প্রশ্ন এখন সবার মধ্যে। 

মৃত্যুর সাথে যে প্রতিনিয়ত লড়াই করে যাচ্ছেন সেই নির্ভিক কলমযোদ্ধা হচ্ছেন বরিশালের গৌরনদী, আগৈলঝাড়া ও উজিরপুরের সবার পরিচিত মোঃ গিয়াস উদ্দিন মিয়া (৩৬)। গৌরনদী উপজেলার কটকস্থল গ্রামের সমাজ সেবক মোঃ জয়নাল আবেদীন মিয়ার পুত্র মোঃ গিয়াস উদ্দিন মিয়া। শখের বসত ১৯৮৬ সালে স্কুল জীবনে (নবম শ্রেনীতে অধ্যারনরত অবস্থায়) টরকী বন্দরের হোমিও প্যাথিক ডাক্তার ও তৎকালীন সময়ের সাংবাদিক ডাঃ খায়রুল আখিয়ার কাঞ্চনের হাত ধরে সাপ্তাহিক জাগ্রত জনতার মাধ্যমে সংবাদপত্র জগতে গিয়াস উদ্দিন সংবাদপত্রর জড়তে আত্মপ্রকাশ করেন। এরপর আর থেমে থাকেননি এ কলমযোদ্ধা। ১৯৮৮ সালে বরিশাল থেকে প্রকাশিক দৈনিক প্রবাসী পত্রিকার গৌরনদী প্রতিনিধি হিসেবে নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। ফলশ্র“তিতে এক পর্যায়ে ওই পত্রিকার বার্তা সম্পাদকের গুরু দায়িত্ব পান। তিনি ১৯৮৮ সালে এস.এস.সি পরীক্ষায় মানবিক বিভাগে প্রথমবিভাগসহ কেন্দ্রে প্রথমস্থান লাভ করেন। কলেজ জীবনে দৈনিক আজকের কাগজ পত্রিকার গৌরনদী প্রতিনিধি ও খুলনা থেকে প্রকাশিক দৈনিক পূর্বাঞ্চল পত্রিকার ভ্রাম্যমান প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন। সাহসী সাংবাদিকতার ফলে ১৯৯৮ সালে সাংবাদিক সমিতির পক্ষ থেকে তাকে ক্রেস্ট ও সনদ প্রদান করা হয়। দৈনিক প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকে গৌরনদী প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে তিনি। ২০০১ সালে দৈনিক ইত্তেফাকের গৌরনদী সংবাদদাতা হিসেবে যোগদান করেন। দীর্ঘদিন ইত্তেফাকে সুনামের সহিত কাজ করে ২০০৭ সালে দৈনিক সমকালের গৌরনদী প্রতিনিধি হিসেবে যোগদান করেন। পাশাপাশি বরিশাল থেকে প্রকাশিত দৈনিক আজকের বার্তার প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকে গৌরনদী প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। ১৯৯৮ সালে সাপ্তাহিক গৌরনদী পরিক্রমা নামের একটি পত্রিকার সম্পাদনা করেন তিনি। সর্বশেষ দেশের স্বনামধন্য বসুন্ধরা গ্র“প কর্তৃক পরিচালিত দৈনিক কালের কন্ঠের গৌরনদী প্রতিনিধি হিসেবে সুনামের সাথে তার দায়িত্ব পালন করেন।

সহকর্মী কলমযোদ্ধাদের সঠিক দিকনির্দেশনা দেয়ার ফলশ্র“তিতে তিনি একাধিকবার গৌরনদী প্রেসক্লাবের সভাপতি নির্বাচিত হন। দেশের যেকোন অঞ্চলের সাংবাদিক নির্যাতনের খবর শুনলে তিনি সহসাই প্রতিবাদি কন্ঠস্বর নিয়ে স্বোচ্ছার হয়ে ওঠেন। সাংবাদিকতার জীবনে সাহসী সংবাদ প্রকাশের কারনেই তার বাসভবনে একাধিকবার বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। এছাড়াও সর্বহারা ও জঙ্গী সংগঠনের সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশের কারনে তার জন্য পাঠানো হয় কাফনের কাপর। সন্ত্রাসীদের হামলা ও নানা ধরনের ভয়ভীতির ঘটনা ঘটে অসংখ্যবার। সন্ত্রাসীদের হুমকির মুখে একাধিকবার তাকে এলাকা ছেড়ে আত্মগোপন করতে হয়। তার পরেও থেমে থাকেনি এ সাহসী কলমযোদ্ধার কলম। বস্তুনিষ্ঠ ও সাহসী সংবাদ প্রকাশের কারনে তার বিরুদ্ধে একাধিকবার মিথ্যে ও হয়রানীমূলক মামলা দায়ের করা হয়। যার মধ্যে একটি মামলা এখনও আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।

সাংবাদিকতার পাশাপাশি তিনি একাধিক সমাজিক সংগঠনের পৃষ্ঠপোষতকা করছেন। পালন করছেন বাংলাদেশ গ্রামীণ সাংবাদিক সংগঠনের বরিশাল বিভাগীয় কমিটির সভাপতি হিসেবে গুরু দায়িত্ব। সর্বদাই তার একটি কথাছিলো, মা আলহাজ্ব কহিনুর বেগম ও  স্ত্রী আফরোজা আক্তার কলির উৎসাহে ও জনগনের ভালবাসায় আজ এখানে আসতে পেরেছি। মা, স্ত্রী, কন্যা সুরাইয়া উদ্দিন মোহনা ও পুত্র মিরাজুল ইসলাম পিয়ালকে নিয়েই তার সুখের সংসার ছিলো।

তিনি আমাকে তার ছোট ভাইয়ের চেয়ে বেশি আদর ও স্নেহ করতেন। আমার সুখে-দুঃখে তাকে পেতাম রাত তিনটার সময়েও। শুধু আমরাই নয়। সহকর্মী যেকোন ব্যক্তি কিংবা এলাকার জনগনের যেকোন সমস্যায় তিনি তাৎক্ষনিক ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে সমাধান করে দিয়েছেন নিজের মনে করে। তার একটি কথাই আজ বার বার মনে হয়, বলতেন, ‘যতদিন বেঁচে আছি জনগনের ভালবাসায় সমাজের উপেক্ষিত ও অবহেলিতদের নিয়ে এবং সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কলম দিয়ে যুদ্ধ করে যাবো’।

শুধু কলম যোদ্ধাই নয় এই মহানুভব ব্যক্তিটি গত ১৫ অক্টোবর সংবাদ সংগ্রহের জন্য মোটরসাইকেলযোগে গৌরনদীর বাটাজোরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। পথিমধ্যে বরিশাল-ঢাকা মহাসড়কের আশোকাঠী ফিলিং ষ্টেশনের সম্মুখে পৌঁছলে বিপরীতদিক থেকে বেপরোয়াগতিতে আসা ডিজেলচালিত নসিমন ট্রলি মোটরসাইকেলের ওপর উঠিয়ে দেয়। এতে মটরসাইকেলের সম্মুখ ভাগ দুমরে মুচরে যায়। গুরুতর আহত হন সাংবাদিক গিয়াস উদ্দিন মিয়া। মুমুর্ষ অবস্থায় তাকে প্রথমে গৌরনদী হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে অবস্থার অবনিত হলে তাৎক্ষনিক উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় প্রেরন করা হয়। ঢাকায় প্রথমে তাকে সিটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে তার প্রথম অপারেশন করা হয়। সিটি হাসপাতালে তার অবস্থার অবনতি হলে জরুরি ভাবে তাকে  শমরিতা হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। বর্তমানে তিনি শমরিতা হাসপাতালে ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালের চিকিৎসক ডাঃ আব্দুস ছামাদ, ডাঃ দীপু, ডাঃ জাহিদ, ডাঃ আমিনুল ও ডাঃ পাপ্পু’র তত্বাবধানে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। গত ২৩ অক্টোবর তার পায়ে আরো একবার ট্রাকসন পয়জন নিস্কাশন (এসথ্রি) অস্ত্রপাচার করা হয়। বর্তমানে তার পায়ে ৩টি ইট বেঁধে টানা দিয়ে রাখা হয়েছে। ডায়াবেটিস জনিত সমস্যার কারনে তার প্রধান অপরেশনটি এখনও করা সম্ভব হয়নি। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রনে আসলেই তার প্রধান অপারেশনটি করা হবে। অপারেশনের মাধ্যমে সাংবাদিক গিয়াসের ডান পায়ের ৩ জায়গার ভাঙ্গাস্থান ঠিক করা হবে বলে জানিয়েছেন শমরিতা হারপাতালের মেডিকেল অফিসার ডাঃ শাহিনা আক্তার।

শিশুদের মতো বিলাপ করে  সাংবাদিক গিয়াস উদ্দিন বলেন, “অসহ্য যন্ত্রনায় আর থাকতে পারছি না। মনে হয় নিজেকে গলা টিপে হত্যা করি। এত যন্ত্রনা আর সহ্য হচ্ছে না” তার বিলাপ শুনে চোখে পানি রাখতে পারছিলাম না। ঢাকা স্থান্তরের পর থেকে সাংবাদিক গিয়াস উদ্দিন ফোকাস বাংলা নিউজের চেয়ারম্যান কামাল হোসেনের আর্থিক সহযোগীতায় চিকিৎসা নিচ্ছেন। এমনকি সাংবাদিক গিয়াস উদ্দিনের প্রথম অপারেশনে রক্ত শূণ্যতা দেখা দেয়ার পর এ মহানুভব ব্যক্তি (কামাল হোসেন) তার শরীরের রক্ত দেয়ার পর সাংবাদিক গিয়াসের প্রথম অপারেশন সম্পন্ন হয়।

সাংবাদিক গিয়াসের স্ত্রী আফরোজা আক্তার কলি জানান, কালের কন্ঠ অফিস থেকে অদ্যবর্ধি তাদের সাথে এমনকি সাংবাদিক গিয়াস উদ্দিনের চিকিৎসার জন্য কোনো প্রকার সাহায্য সহযোগিতা কিংবা কেউ দেখতে পর্যন্ত আসেননি। প্রতিনিয়ত এখন সাংবাদিক গিয়াস উদ্দিন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে যাচ্ছেন।

-লেখক : খোকন আহম্মেদ হীরা,
সম্পাদক Gournadi.com