মানিবুকারস – অর্থ লেনদেনের সহজ ও নিরাপদ পদ্ধতি – জাকারিয়া চৌধুরী

প্রতিষ্ঠানটিকে আগের বছরের তুলনায় দ্বিগুণ লাভ করেছে, যা একে বিশ্বের একটি সফল অর্থ লেনদেনের প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে। বর্তমানে মানিবুকারসের নব্বই লক্ষ একাউন্ট হোল্ডার রয়েছে। এটি বাংলাদেশসহ বিশ্বের দুইশতটিরও বেশি দেশে ৮০ প্রকারের অর্থ লেনদেনের সুবিধা প্রদান করে। ৪৫ হাজারেরও বেশি মার্চেন্ট প্রতিষ্ঠান মানিবুকারের মাধ্যমে অনলাইনে সার্ভিস দিয়ে থাকে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে eBay.com, Skype.com, GetAFreelancer.com, MochiMedia.com এবং ThemeForest.com। মানিবুকারস কতটা জনপ্রিয় তার একটি দৃষ্টান্ত হচ্ছে, বর্তমানে প্রতিদিন ১২ হাজারের উপর নতুন ব্যবহারকারী মানিবুকারসে রেজিষ্ট্রেশন করে।

মানিবুকারসকে ধরা হয় পেপালে প্রধান বিকল্প হিসেবে। বিশেষ করে যেসকল দেশে পেপালের কোন সাপোর্ট নেই সেসব দেশের জন্য মানিবুকারস একটি আদর্শ মাধ্যম। এটি পেপালের মতই নিরাপদ, দ্রুত এবং সাশ্রয়ী অর্থ লেনদেনের পদ্ধতি। এর মাধ্যমে একজন ব্যবহারকারী থেকে অপর আরেকজনের কাছে মূহুর্তের মাধ্যে অর্থ লেনদেন করা যায়। এতে খরচ পড়ে সর্বোচ্চ ০.৫ ইউরো। অর্থ লেনদেনের জন্য প্রাপকের নাম বা ব্যাংক একাউন্ট কিছুই জানার প্রয়োজন নেই, কেবল তার ইমেইল ঠিকানাটিই যথেষ্ঠ। মানিবুকারস দিয়ে খুব সহজেই ২০ হাজারের উপর ইকমার্স ওয়েবসাইট থেকে অনলাইনে কেনাকাটা করা যায়। মানিবুকারসকে আপনার ওয়েবসাইটের সাথে যুক্ত করে আপনি নিজেই একটি ইকমার্স সাইট চালু করতে পারবেন। বর্তমানে বেশিরভাগ ফ্রিল্যান্সি মার্কেটপ্লেসে মানিবুকারস সাপোর্ট করে। এক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে কম খরচ পড়ে, মাত্র ১.৯%। ফ্রিল্যান্সিং সাইট ছাড়া কোন ব্যক্তি থেকে অর্থ গ্রহণের জন্য কোন ফি দিতে হয় না। মানিবুকারসের একাউন্ট থেকে নিজের ব্যাংকে টাকা নিয়ে আসতে মাত্র ২.৬৫ ডলার খরচ পড়ে।

রেজিষ্ট্রেশন করার পদ্ধতি:

মানিবুকারস এ রেজিষ্ট্রেশন অত্যন্ত সহজ, যা কয়েক মিনিটের মধ্যেই সম্পন্ন হয়ে যায়। তবে মানিবুকারসের সম্পূর্ণ সুবিধা পেতে হলে কয়েকটি বিষয় নিশ্চিত করতে হবে। মানিবুকারসের নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য এটি প্রত্যেক ব্যবহারকারীকে তিনটি পদ্ধতিতে যাচাই করে থাকে। এগুলো হচ্ছে – ঠিকানা যাচাই, ব্যাংক একাউন্ট যাচাই এবং ক্রেডিট/ডেবিট কার্ড যাচাই। তৃতীয় পদ্ধতিটি হচ্ছে ঐচ্ছিক, তবে প্রথম দুটি অবশ্যই সম্পন্ন করতে হবে।

ঠিকানা নিশ্চিত করা:

লগইন করার পর My Account পৃষ্ঠায় Account Status অংশ থেকে Address Verify লিংকে ক্লিক করুন। পরবর্তী পৃষ্ঠায় আপনার ঠিকানাটি দেখাবে, এরপর “Send me a verification letter” বাটনে ক্লিক করুন। মানিবুকারস আপনার ঠিকানায় একটি চিঠি পাঠাবে। চিঠিটি আসতে কয়েক সপ্তাহ সময় লাগতে পারে। চিঠিতে আপনাকে ছয়টি সংখ্যার একটি কোড পাঠানো হবে। কোডটি পাবার পর সাইটে লগইন করে “My Account” > “Profile” পৃষ্ঠায় গিয়ে আপনার ঠিকানার পাশের “Verify” লিংকে ক্লিক করুন। তারপর সেই কোডটি জমা দিন। এরপর আপনি মানিবুকারসের মাধ্যমে অর্থ লেনদেন শুরু করতে পারবেন।

ব্যাংক একাউন্ট যোগ করা:

মানিবুকারস থেকে আপনার ব্যাংকে অর্থ উত্তোলন করতে হলে My Account থেকে প্রথমে একটি ব্যাংক যোগ করে নিন। এক্ষত্রে আপনার ব্যাংকের SWIFT কোড, ব্যাংকের ঠিকানা, আপনার ব্যাংক একাউন্ট নাম্বার ইত্যাদি দিতে হবে। মানিবুকারসে ব্যাংক একাউন্ট যোগ করার সাথে সাথে আপনি ব্যাংকে অর্থ উত্তোলন করতে পারবেন। তবে এক্ষেত্রে মানিবুকারস আপনার ব্যাংক একাউন্টটি যাচাই করতে বলবে। ব্যাংক একাউন্ট যাচাই করার জন্য ব্যবহারকারীর ব্যাংক থেকে মানিবুকরসের একাউন্টে সামান্য পরিমাণ অর্থ (৫ থেকে ১০ ডলার) প্রেরণ করতে হয়। তবে বাংলাদেশের আইনের জন্য কোন ব্যাংক থেকেই মানিবুকারসে কোন টাকা পাঠাতে পারবেন না। এক্ষত্রে নিচের পদ্ধতিটি অনুসরণ করুন –

১। কোন ফ্রিল্যান্সিং সাইট থেকে অর্থ পাবার পর মানিবুকারস দিয়ে একবার উত্তোলন করুন। ব্যাংক একাউন্ট যাচাই না করেও আপনি দুইবার অর্থ উত্তোলন করতে পারবেন। এজন্য লগইন করে Withdraw লিংকে ক্লিক করুন।
২| টাকা ব্যাংকে জমা হবার পর ব্যাংক থেকে বিগত ছয় মাসের একটি ব্যাংক স্টেটমেন্ট চেয়ে নিন।
৩। ব্যাংক স্টেটমেন্টের মধ্যে মানিবুকারস থেকে আপনি যে অর্থ পেয়েছেন তার তারিখ এবং ডলারের পরিমাণ দেখতে পাবেন। কিন্তু এই ডলার কার কাছ থেকে এসেছে তা উল্লেখ থাকবে না। এজন্য আপনাকে ওই লেনদেনের SWIFT Transaction নামক আরেকটি কাগজ সংগ্রহ করতে হবে। সাধারণত ব্যাংক এই কাগজটি আপনাকে দিতে চাইবে না। কিন্তু আপনি যদি পুরো বিষয়টি তাদেরকে বুঝিয়ে বলতে পারেন তাহলে তারা আপনাকে কাগজটির ফটোকপি দিতে সম্মত হবে। প্রকৃতপক্ষে আপনি যে ঘরে বসে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছে তা জানতে পারলে তারা খুশি হয়েই আপনাকে সাহায্য করবে।
৪। ব্যাংকের যথাযথ কর্তৃপক্ষ দ্বারা কাগজগুলো সত্যায়িত করার পর এগুলোকে স্ক্যান করে কম্পিউটারে নিয়ে নিন। সাথে আপনার পাসপোর্টও স্ক্যান করে নিন।
৫| এরপর merchantservices@moneybookers.com ঠিকানায় ইমেইল এটাচমেন্ট করে এগুলো পাঠিয়ে দিন। ইমেইলের Subject হিসেবে Manual Bank Account Verification উল্লেখ করুন এবং তাদেরকে জানিয়ে দিন বাংলাদেশ থেকে যেহেতু কোন টাকা মানিবুকারসে পাঠানো সম্ভব নয় তাই আপনি ব্যাংক স্টেটমেন্ট এবং সংশ্লিষ্ট কাগজের স্ক্যান কপি ইমেইলের সাথে পাঠাচ্ছেন। তারা যেন Manually আপনার ব্যাংক একাউন্ট যাচাই করে নেয়।
৬। ইমেইল পাঠানোর ১ থেকে ২ সপ্তাহের মধ্যে আপনি মানিবুকারস থেকে ইমেইল পাবেন। সবকিছু উপরে উল্লেখিত নিয়ম অনুযায়ী করতে পারলে মানিবুকারস কর্তৃপক্ষ আপনার ব্যাংক একাউন্টটি নিশ্চিত করে নিবে। এরপর আপনি মানিবুকারসের সকল সুবিধা নিরবিচ্ছিন্নভাবে উপভোগ করতে পারবেন।

ক্রেডিট/ডেবিট কার্ড যোগ করা:

যাদের ক্রেডিট/ডেবিট কার্ড রয়েছে তারা ইচ্ছে করলে মানিবুকারসে কার্ডটি যোগ করে কার্ডের টাকা মানিবুকারসে নিয়ে যেতে পারবেন। বর্তমানে অনেকেরই পেওনার প্রদত্ত ডেবিট মাস্টারকার্ড রয়েছে। এই কার্ডের নানাবিধ সুবিধা রয়েছে। তবে এই কার্ডের টাকাকে শুধুমাত্র ATM থেকে ক্যাশ হিসেবে উত্তোলন করতে হয়, ব্যাংকের সাথে এর কোন যোগাযোগ নেই। আপনি যদি কার্ডের টাকাকে আপনার ব্যাংকে জমা রাখতে চান তাহলে ATM থেকে টাকা নিয়ে ব্যাংকে গিয়ে জমা দিতে হবে। ATM থেকে এক দিনে একটি নির্দিষ্ট অংকের বেশি অর্থ উত্তোলন করতে পারবেন না। ফলে বড় অংকের অর্থের ক্ষেত্রে কয়েকদিনে টাকা জমা দিতে হবে, যা ঝামেলাপূর্ণ এবং নিরাপদও নয়। মানিবুকারসের মাধ্যমে সেই কাজটি ঘরে বসেই কয়েকটি ক্লিকের মাধ্যমেই করতে পারবেন। এজন্য প্রথমে আপনার মাস্টারকার্ডটি মানিবুকারসে যোগ করুন। কার্ডটি সঠিকভাবে যাচাই হবার পর উপরের মেনু থেকে Upload Funds লিংকে ক্লিক করে Credit Card অপশনটি সিলেক্ট করুন। এরপর আপনার কার্ডের পেছনে লেখা তিনটি সংখ্যার CVV2 কোড দিন এবং কত টাকা কার্ড থেকে মানিবুকারসে নিতে চান তা উল্লেখ করুন। Next বাটনে ক্লিক করার সাথে সাথেই কার্ড থেকে মানিবুকারসের একাউন্টে টাকা জমা হয়ে যাবে। এরপর মেনু থেকে Withdraw লিংকে ক্লিক করে এই টাকা আপনার ব্যাংক একাউন্টে প্রেরণ করুন। কার্ড থেকে মানিবুকারসে টাকা আনতে ১.৯% চার্জ যুক্ত হবে, যা মাস্টারকার্ডের মাধ্যমে টাকা উত্তোলনের চেয়ে স্বাশ্রয়ী। কারণ পেওনারের মাস্টারকার্ড থেকে ATM এর মাধ্যমে প্রতিবার টাকা উত্তোলন করতে ৩% চার্জ দিতে হয়।

মানিবুকারসের এত এত সুবিধার মধ্যে এর একটি বড় ধরনের অসুবিধা রয়েছে, যার কারণে এটি পেপালের চেয়ে বেশি জনপ্রিয় হতে পারছে না। এটি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে মানিবুকারসের কোন সার্ভিস নেই। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান মানিবুকারসে রেজিষ্ট্রেশন করতে পারে না। যে সকল ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটপ্লেস বা ইকমার্স সাইট যুক্তরাষ্ট্র থেকে পরিচালিত হচ্ছে তারা মানিবুকারসের মাধ্যমে কোন সার্ভিস দিতে পারে না।

মানিবুকারসে ব্যাংক একাউন্ট যুক্ত করে তা যাচাই করাটা প্রথম দিকে একটু ঝামেলাপূর্ণ। কিন্তু একবার যাচাই হয়ে গেলে মানিবুকারসের কল্যাণে অনলাইনে অর্থ লেনদেনের একটি বিশাল ক্ষেত্র আপনার সামনে উন্মোচিত হয়ে যাবে। যা দিয়ে অনলাইন ফ্রিল্যান্সিং, ইকমার্স সাইট তৈরি, অনলাইনে কেনাকাটা ইত্যাদি অসংখ্য কাজে মানিবুকারসকে ব্যবহার করতে পারবেন। বাংলাদেশী ফ্রিল্যান্সাররা তাদের পরিচিতি ক্লায়েন্টের কাছ থেকে এই পদ্ধতিতে কোন খরচ ছাড়াই সরাসরি অর্থ গ্রহণ করতে পারবে (যুক্তরাষ্ট্রের ক্লায়েন্ট ব্যাতীত)। মানিবুকারস একদিকে যেমন স্বাশ্রয়ী, অন্যদিকে নিরাপদ এবং ঝামেলাবিহীণ অনলাইন লেনদেনের মাধ্যম।

লেখক – মোঃ জাকারিয়া চৌধুরী

বিঃদ্রঃ – এই লেখাটি “মাসিক কম্পিউটার জগৎ” ম্যাগাজিনের “নভেম্বর ২০০৯” সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে।